Wednesday, July 6, 2016
সজল
বন্দোপাধ্যায়ঃ আমার মত করে দূরের ও কাছের
যতদূর মনে পড়ে আমি কবি সজল বন্দোপাধ্যায়ের কবিতা প্রথম পড়ি
অশোক চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘ঈগল’ পত্রিকার কোনও একটি সংখ্যায় ১৯৭৯-৮০ সালে।
রায়গঞ্জে থাকতাম তখন। ডাকে আসত পত্র-পত্রিকা। তখন জীবনানন্দ দাশের ঘোর এবং মহিমা
অনেকটাই স্তিমিত হয়ে শক্তি শঙ্খ বিনয় উৎপল জাগ্রত আমার মধ্যে। সঙ্গে খোঁজ চলছে,
অন্যরকম কিছু্র, নতুন কিছুর, চেষ্টা চলছে ভিন্ন স্বাদ ও পরিবেশনার পত্র-পত্রিকাগুলোর কাছে পৌঁছুনোর,
অবশ্যই ডাক ভরসায়। তখন মফস্বল বাদেও কলকাতার কিছু পত্র-পত্রিকায় (পূর্বোক্ত
‘ঈগল’, যজ্ঞেশ্বর রায় সম্পাদিত ‘চিল’, সুশীল রায় সম্পাদিত ‘ধ্রুপদী’, ডঃ
শুদ্ধসত্ত্ব বসু সম্পাদিত ‘একক’, দেবকুমার বসু সম্পাদিত ‘সময়ানুগ’, উত্তম দাশ
সম্পাদিত ‘মহাদিগন্ত’, তাপস সাহা সম্পাদিত ‘রবিবাসরীয় জনতা’, কেদার ভাদুড়ী জয়ৎ সেন
সম্পাদিত ‘ব্যতিরেক’, শিশির ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘অন্যদিন’ ইত্যাদি) ডাক যোগাযোগে আমার বেশ কিছু কবিতা ছাপা হত। একমাত্র দেবকুমার
বসু ছাড়া কারো সঙ্গে পরিচয়ই ছিল না। সেই
সুবাদে ‘ঈগল’, ‘চিল’, ‘মহাদিগন্ত’, ‘সময়ানুগ’ এবং
অতীন্দ্রিয় পাঠক সম্পাদিত ‘অব্যয়’ ইত্যাদি পত্রিকায় কবি সজল বন্দোপাধ্যায়কে
আমার সেই সময় সামান্য পড়া। সেই ২৩-২৪ বছর বয়সে ‘শ্রুতি’ আন্দোলনের নামটুকু ছাড়া
‘শ্রুতি’ নিয়ে তখনও আমি বিশেষ কিছুই জানি
না। ষাটের দশকে কবিতা নিয়ে ভিন্ন ধরণের কাজ করতে চাওয়া এই কবির কবিতা আমি তার আগে
পড়িনি। আমার কাছে কোনও বইও ছিল না , বা লাইব্রেরীতেও পাইনি। মনে পড়ে অনেক কিছু
কথা। অগত্যা, ধুলো ঝেড়ে বার করা গেল সেই ‘ঈগল’ (তৃতীয় বর্ষ/ প্রথম-দ্বিতীয় যুগ্ম
সংখ্যা, জ্যৈষ্ঠ ১৩৮৬/ মে ১৯৭৯)। আমার প্রথম পড়া সজল বন্দোপাধ্যায়ের কবিতা।
সজল বন্দোপাধ্যায়
পিকাসোর নীল জামা
অনেকবার
নিজের ছায়ায়
নীল আঙুল তুলে
চাঁদের ওপর
মুকুট রেখে
মন্দির ছুঁয়ে
পাহাড় ডিঙিয়ে
নদী পেরিয়ে
পথ হারিয়ে
বুকের ওপর জলের
ফোঁটায়
নীল আঙুল তুলে
অনেকবার
নৌকোটাকে
ডাকতে ডাকতে
পার্ক স্ট্রীটের
ভিড়ে
নাকতলায়
ভরদুপুরে
নীল আগুনে
অনেকবার
আমার পাঞ্জাবীর
মধ্যে
পিকাসোর নীল
জামা (বানান অপরিবর্তিত)।
আজ আর মনে নেই
কবিতাটি পড়ে আমার তখন ঠিক কী মনে হয়েছিল। কিন্তু এটা মনে আছে তাঁর কবিতা হন্ট
করেছিল আমাকে। সেটি যে প্রথাগত কোনও কবিতা নয় তা জানান দেওয়া ছিল বর্ণে বর্ণে
পঙক্তিতে পঙক্তিতে। ধরন গড়নও ছিল বেশ কিছু আলাদা। একটা আগ্রহ তৈরি করার পক্ষে তা
ছিল যথেষ্ট। খোঁজের তাগিদ তৈরি করেছিল সেই কবিতা। ফলে সেইসময় তাঁর কবিতা পেলেই
পড়তাম। এভাবেই কবিকে পাওয়া শুরু হয়েছিল আমার।
১৯৮৬-৮৭ সালে কলকাতা বই মেলা থেকে সজল বন্দোপাধ্যায়ের
‘ব্রায়ার পাইপ’ কাব্যগ্রন্থটি আমি সংগ্রহ করি, খুব সম্ভবত মহাদিগন্ত থেকে।
‘ব্রায়ার পাইপ’ বইটি আমার মধ্যে একটা আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল, যদিও কীভাবে আলোড়িত
উদ্দীপিত হয়েছিলাম তা মনে নেই আদৌ। এই সময় কালে কবি
উত্তম দাশ রচিত ‘হাংরি, শ্রুতি ও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন’ বইটি আমার শ্রুতি আন্দোলন
সম্পর্কে অজ্ঞতা অনেকটাই মুছে দেয়। এছাড়াও এ বিষয়ে বেশকিছু প্রবন্ধ নিবন্ধ আন্দোলন
সম্পর্কে একটা সম্যক ধারনা তৈরি করে। স্বাভাবিকভাবেই সে সময় তাঁদের আন্দোলন
ইসতেহারের প্রেক্ষিতে ‘ব্রায়ার পাইপ’ বইটিকে আবারও অবলোকন করার চেষ্টা করেছিলাম। কবি আমার কাছে আরেকটু
স্বচ্ছতা নিয়ে প্রকাশ পেলেন।
২০০২-০৩ সাল নাগাদ কলকাতায় কোনও একটি অনুষ্ঠানে আমি কবি সজল
বন্দোপাধ্যায়কে প্রথম দেখি। এরমধ্যে অবশ্য কবির আরও দুটো কবিতার বই পড়ার (‘ভ্রমণ’,
‘পান্ডু(র) লিপি’) সুযোগ পাই। বেটেখাটো, লালচে সাদা সাহেব প্রায়, সবসময় হাসিমুখ।
কী একটা আকর্ষণ থাকায় (কবি না কবিতার) নিজে থেকে আলাপ পরিচয় করতে অস্বস্তি অপারগতা
থাকা সত্তেও অনুষ্ঠান শেষে পরিচিত হতে চাই জাস্ট দু-একটা কথায়। ২০০৬ সালে অতনুরা
(বন্দোপাধ্যায়) ‘এখন’ এর তরফে ‘কবি সজল বন্দোপাধ্যায় সংখ্যা’ প্রকাশ করে। আবার
তাঁকে ফিরে দেখা হয় আমার (যদিও আমার কোনও লেখা সেখানে ছিল না) পড়ার মাধ্যমে। ২০০৭
সালে জলপাইগুড়িতে এখন পত্রিকার উদ্যোগে কবিতা আড্ডায় আমি কবিকে ব্যাক্তিগতভাবে
আরেকবার দেখার, দু-চারটে কথা বলা্র, কবিতা শোনার ও শোনানোর সু্যোগ পাই। মাত্র এই
দুবারই। ২০১৪ সালে অর্পণ পাল সম্পাদিত ‘শ্রুতি সংকলন ২০১৪’ য় আরেকবার ঝালিয়ে নিই
তাঁকে। স্বাভাবিকভাবেই দূরের কবিকে আমার জানার মাধ্যম তাঁর কবিতাই, আর বার বার
সেটা রিন্যুয়াল হতে থাকে।
সময়কালের বিচারে আজ মনে হতে পারে ষাটের সাহিত্য আন্দোলন
আলোড়নগুলি অনেকটা স্বাভাবিকই ছিল। নব্য স্বাধীনতা, দেশভাগের রেশ, বাংলায়
মার্ক্সবাদী চিন্তা-চেতনার প্রসার, গ্রামে রুটি-রুজির সংকুলান কমে আসায় নগরজীবনের
ওপর অতিরিক্ত চাপ, শিক্ষা প্রসারের তুলনায় কর্মসংস্থানের অভাব ইত্যাদি একদিকে যেমন
সামাজিক অবস্থাটিকে নিয়ন্ত্রন করছিল অন্যদিকে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে নব্য
চিন্তার প্রয়াস, বিদেশী শিল্প সাহিত্যের (বিশেষত ইউরোপিয়) প্রভাব, আগেই শুরু হওয়া
রবীন্দ্র পরিমন্ডল থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদ, এমনকি জীবনানন্দ দাশের অনুকরণ, প্রভাব
ও এক্সটেনশনের উর্ধ্বে ওঠার লক্ষ্য
সাহিত্যের বাতাবরণটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। কবিতার ক্ষেত্রে রবীন্দ্র বিরোধিতার
নামে রবীন্দ্রনাথ থেকে দু-কদম বাইরে না যেতে পারা, জীবনানন্দের দুর্বার প্রভাবে
অনেক নক্ষত্রের কবিতা অভিসার বা তাকে অস্বীকার করেও প্রকৃত অর্থে তাকেই জড়িয়ে ধরা,
বিশেষ বাঁক না-খাওয়া পঞ্চাশের দশক, এবং সর্বোপরী বিশ্ব-অঙ্গনের নতুন নতুন আন্দোলন
আলোড়নের উত্তাল ঢেউ-এ নিজেদের আন্দোলিত হয়ে পড়ার মধ্যে মুক্তি খোঁজার তাগিদ ও
আনন্দ এই আন্দোলন আলোড়নগুলির রাস্তাকে মসৃণ করেছিল। এরই মধ্যে ‘শ্রুতি’ এক প্রয়াস,
স্বল্পস্থায়ী, কিন্তু বেশ কিছুটা প্রভাব ফেলায় সক্ষম। আর এর সঙ্গেই আগাগোড়া জড়িয়ে
থাকা কবি সজল বন্দোপাধ্যায়।
কী করতে চেয়েছিলেন তাঁরা? ইসতেহার ছিল। তবু শুনি খোদ কবির
লেখা থেকে। কিছুটা মেলানোর চেষ্টা করি তাঁরই কবিতার সঙ্গে। বস্তুত তখনও একবার
মেলানোয় বা অবলোকনে প্রয়াসি হয়েছিলাম। আজ আবার
নতুন করে। সময় যেমন বসে নেই, একই হয়ে নেই আমার চিন্তা-চেতনার পরিসর, এরই মধ্যে এই
আন্দোলন নিয়ে জানার পরিধিও বেড়েছে, নিছক কৌতুহলের জায়গা নিয়েছে বিশ্লেষণ করে দেখার
প্রবনতা, আর অনুভূতির সূক্ষ স্তরগুলো আরও ধারালো না ভোঁতা হয়েছে না-জেনে বা সংশয়ে
থেকেও তারই ওপর দায়-দায়িত্ব দেওয়ায় বিশ্বাস রাখা।
কবি সজল বন্দোপাধ্যায় ‘শ্রুতিঃ ফিরে দেখা’ নিবন্ধে
আন্দোলনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলোকে তুলে ধরেছেন। নেতিবাচকতায় মূলত সাংগঠনিক ও
ব্যক্তিক দিকের কথাই আছে। ফলে কবিতা ও কবিতাভাবনার ওপরে মূলত জোর পড়েছে
ইতিবাচকতায়। সেই জায়গাটা ধরেই কবিকে পাওয়া ব জানা যেতে পারে।
উনি লিখছেনঃ (সংক্ষিপ্ত আকারে)
ক) কবিতা
অনুভবের নিছক ব্যাখ্যা বা বিবরণ নয়, বরং অনুভবের আবহ-প্রকাশ। বিবৃতিময়তা ও অতিকথন,
ও পুনরাবৃত্তির দিকে বাংলা কবিতার বিশেষ ঝোঁক আছে। আমরা বিবৃতিকে পরিহার করতে
চেয়েছি।
খ) ...। আমরা কবিতায়
রহস্যময়তার অতিরিক্ত একটি মাত্রা সচেতনভাবে যুক্ত করতে চেয়েছি।
গ) কখনো কখনো
সংলগ্ন বা অসংলগ্ন ছবির পর ছবি সাজিয়ে কবিতা নির্মাণ করতে চেয়েছি। ...
ঘ) কোনো কোনো
কবিতায় মন্দ্রময় উচ্চারণ-এর মাধ্যমে কবির আন্তর জগতের রহস্য স্পন্দিত হ’য়ে উঠেছে।
ঙ) পরবর্তী কালের
কিছু কিছু কবিতায় নির্মোহভাবে কিছু বিবৃতি সাজানো হয়েছে, অথচ কোথাও কাব্য করা হয়
নি। ফলে গোটা আবহ থেকে কবির অনুভব উৎসারিত হয়েছে।
চ) ...।
প্রযুক্তিবিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রণ শিল্পেরও ক্রমোন্নতি ঘটেছে। আমরা
তা কবিতায় কাজে লাগাতে চেয়েছি।
ছ) কোথাও
স্পেসের ব্যবহারে, কোথাও ছাপার টাইপের ব্যবহারে আমরা অনুভবের বহিরঙ্গ রূপ
অভিনবভাবে ব্যক্ত করেছি।
জ) পংক্তি
বিন্যাসে আমরা সচেতনভাবে নতুনত্ব আনতে চেয়েছি। কাটা কাটা ছোট ছোট পংক্তি সাজিয়েছি।
কখনো কখনো কি গদ্যের কি পদ্যের ভঙ্গীতে লেখা কবিতায় ছেদ-যতির অবলুপ্তি ঘটিয়ে নতুন
আবেদন সৃষ্টি করতে চেয়েছি।
ঝ) সবচেয়ে বড়
কথা, আমরা বাংলা কবিতায় বিশেষভাবে পরিমিতিবোধের অনুশীলন করতে চেয়েছি।
ঞ) ফলে, তলেতলে
ভাবালুতা (...) বর্জন করে কবিতায় কাঠিন্য বা ঘনত্ব আনতে চেয়েছি।
ট) আলংকারিতা,
বিশেষণের যথেচ্ছ প্রয়োগ – এসব ব্যাপারেও সুসংযমী হতে চেয়েছি।
ঠ) আমরা বিশ্বাস
করেছি, কবিতা ভাবের ঘোরে বা আবেগের আতিশয্যে লেখা হয় না, কবিতা সংযমী সাধনার ফল।
ড) ঐতিহ্যকে
স্বীকার করেও আমরা সুপরিকল্পিতভাবে গতানুগতিকতার বাইরে যেতে চেয়েছি।
তো এইরকম কিছু চিন্তাভাবনা গঠনগত কৌশল প্রকরণ এবং আন্তরিক
প্রয়াসের মাধ্যমে গতানুগতিকতার বাইরে যাওয়াই ‘শ্রুতি’র ফলশ্রুতি। আজ, একটি শব্দে
একটি পঙক্তি গঠন, দুটি বা তিনটি বাছাই শব্দে পঙক্তির মিতকথন, অসমাপিকা ক্রিয়ায় গড়া
বাক্যের ধ্বনিগত গুন, একটা চিত্রধর্মিতা ছড়িয়ে রাখার মাধ্যমে ‘পিকাসোর নীল জামা’
কবিতাটির গড়ন আমার মধ্যে সম্পূর্ণতা পায় এক আবিস্কারে—‘আমার পাঞ্জাবীর মধ্যে/
পিকাসোর নীল জামা’।
এবারে কবির একটি কবিতা ‘ব্রায়ার পাইপ’ থেকে।
‘এসো/ ভাঁড়ারে চাল আছে গল্প
করি/ এসো/ পরার কাপড় আছে গল্প করি/ এসো/ বাচ্চাদের দুধের বোতল সামনে রেখে/ গল্প
করি/ তোমরা গল্প করতে করতে বলো/ বেঁচে আছি/ আমিও বলি/ বেঁচে আছি/ গল্পের মধ্যে
বেঁচে থাকা/ বেঁচে থাকার গল্প’ (গল্পসল্প)।
কী করতে চান কবি? কী বলতে চান তিনি? কী তাঁর অভীপ্সা? কী ই
বা উদ্দেশ্য? এসব প্রশ্নের উত্তরে এই কবিতার নান্দনিকতার দিকটি অবহেলিত হবে জেনেও
একটু কাঁটাছেঁড়া করতেই হয় শুধু মিলিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে। তত্ত্ব আর তার প্রয়োগের
রূপরেখাটির সংশ্লেষণ ঠিক কতটা! করতে তিনি চান কিছু। পঙক্তির বিন্যাসে ভিন্নতা,
গদ্যের ছেদ-যতির অবলুপ্তি, অলংকার বিশেষণ ইত্যাদি ছাড়া, পরিমিতি সচেতনতা,
কবিতা-রহস্যের ওপরেও বাচনভঙ্গীতে, বিশেষত পুনরাবৃত্তির কৌশলে রহস্যের অতিরিক্ত মাত্রা
যোগ, এসবের মাধ্যমে সুপরিকল্পিতভাবে প্রচলিত গতানুগতিকতার বাইরে বেরিয়ে যেতে চান।
না, এই কবিতায় উনি কিছুই বলতে চান বলে আমার মনে হয় না। বক্তব্য কিছু নেই। আছে এক
ধরণের চিত্রধর্মিতা। আছে রোম্যান্টিসিজমকে (যা সেই সময়ের কবিতার একটি বহুল প্রচলিত
আবেদন) সমূলে আঘাত করা, এবং সেখান থেকে আকন্ঠ বেরিয়ে আসা। কোনও যৌন আবেদন বা
বিকৃতি এতে নেই। বরং আছে কমিটমেন্টহীন সমাজ সম্পৃক্ততা। এসবই তাঁকে আলাদা করে আর
আমার সঙ্গে তাঁর দূরত্ব কমায় প্রিয় হয়ে ওঠার মাধ্যমে।
‘পান্ডু(র) লিপি’ বইটা থেকে একটা কবিতা বেছে নিয়ে উদ্ধৃত
করা যাকঃ
একটি পান্ডুলিপি
জন্মের মুহূর্তে
কালপুরুষ মন্ত্র
উচ্চারণ করলেন –
পান্ডুলিপি হও –
সেই থেকে
ভালবাসার হরফ
ঘৃণার দাঁড়ি
খ্যাতির
উদ্ধৃতি-চিহ্ন
অপমানের
অর্ধ-ছেদ
নিজেই অক্ষরে
অক্ষরে ক্ষতবিক্ষত
একটা পান্ডুলিপি
আর শেষে একটা সই
–
সজল
বন্দোপাধ্যায়
এখানে দেখি দর্শনের দিকে ঝোঁক। কিন্ত সে কোনও ভারবাহী গাধা
নয়। দর্শন শেষাবধি কোনও মেসেজের উপস্থাপনা করেনি। লীন হয়ে থেকেছে কবিতার প্রাণ
হয়ে। বিবৃতি আছে, কিন্তু তা এমন সাধারণ ও নগন্য করে নির্মোহভাবে শব্দে শব্দে বাঁধা
যেন তা বিবৃতি নয়, স্রেফ অনুভবমালা। এছাড়া শৈলী। বলার ঢং। কী আমি বলবর চেয়েও
কীভাবে বলবর প্রাধান্য। আমার মনে হয়েছে কোনও একসময় (প্রথমদিকে) আঙ্গিকের কারিগরিই
হয়ত প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। কিন্তু পরের দিকে কবিতায় ওতপ্রোত হয়েছে কবির ভাবনা
প্রসূত দর্শন। এটা এক রূপান্তর।
তাহলে একবার ফিরে গিয়ে দেখা যাক আঙ্গিক প্রাধান্যের একটা কবিতা।
কারা কথা বলতে বলতে (অগ্রন্থিত নির্বাচিত কবিতা)
স্থি
এবং দুচোখের
মধ্যে র চেয়ার টেবিল বই
আমি হ ঘর
য়ে
সা শু এ
রা য়ে বং
দি আ ন
ন ছি ক্ষ
ঃ ঃ ত্র
ঃ
কা রা
বা সে ট্রা
মে প থে
কা রা
পা য়ে র
শ ব্দে ক
থা ব ল
তে
ব ল
তে
কবরের মধ্যে
না
ভি
ত
রে
এটি মুদ্রণশিল্পের অগ্রগতিকে
কবিতার কাজে লাগানো। তাঁরই অগ্রজ কবি মণীন্দ্র গুপ্ত কীভাবে বিষয়টি বিশ্লেষণ
করেছেন একবার দেখা যাক। “ ‘ষাটে’র কবিরাও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। পরেশ মন্ডল,
সজল বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ কবিরা টাইপোগ্রাফি ও মুদ্রণবিন্যাসের সাহায্যে কবিতার
নতুন দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপ এনে নতুন অনুষঙ্গ/ ব্যঞ্জনা ফোটাতে চেয়েছিলেন। এই অভিনব
প্রক্রিয়া বাঙলা কবিতায় নতুন হলেও, এর পিছনে ছিলেন পশ্চিমী আপোলিনেয়ার, কামিংস্-ইত্যাদি।
এঁদের অনুকরণের সার্থকতা এইটুকুই যে তা কবিতার দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপের প্রয়োজনীয়তার
দিকে বাঙালি কবিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।” হ্যাঁ শ্রুতির কবিদের মধ্যে বিশেষত কবি
সজল বন্দোপাধ্যায় ও কবি পরেশ মন্ডল এই কাজটি করেছিলেন। তাঁরা নির্মাণ আঙ্গিকের
মাধ্যমেও কবিতার প্রচল ধারাটিকে ভেঙে পাঠকের চোখে দেখার ভঙ্গিটিকে বদলে দিতে
চেয়েছিলেন। কিছুটা সফলও হয়েছিলেন।
ঠিক বিপরীতেও তাঁর চলা আছে।
সেখানে তিনি সাংগিতীক। শুনেছি খুব ভালো গাইতেন তিনি। তার রেশ হতেও পারে। সুরকে
সহায় করা শব্দ নির্বাচনের ধ্বনি মাধুর্য্যটিকে প্রাধান্য দিয়ে। ভাবনাতেও ছিল।
‘মন্দ্রময় উচ্চারণ-এর মাধ্যমে কবির আন্তর জগতের রহস্য স্পন্দিত’ করে তোলা। ‘মিড়’ কাব্যগ্রন্থের
২০ নং কবিতাটি এই রকমঃ
সারাদিন
এস্রাজ বাঁধা –
সারারাত
তার ছিঁড়ে ফেলা
এস্রাজ আছে বলেই সাংগিতীক নয়। ‘এস্রাজ বাঁধা’ এই মিত মন্দ্রময় উচ্চারণ।
‘সারাদিন’ শব্দটির ব্যাপ্তির মধ্যে ধ্বনিগত সুর। আর ‘সারারাত’ দিয়ে বিপরীত
ব্যাপ্তির চিন্তনে সুরের খাদে নেমে আসা। শেষে ‘তার ছিঁড়ে ফেলা’র মত মন্দ্র
উচ্চারণে বিষাদ যন্ত্রনা আকূতিকে না-উচ্চ স্বরে তীক্ষ্ণ অনুনাদ সৃষ্টি এক অসাধারণ
সাংগিতীকির উদাহরণ হয়ে যায়। কবির নিজস্ব কথাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। ‘আমি
বিশ্বাস করি কবিতায় এক ধরণের সাংগীতিক মন্ত্রময়তা রনিত হওয়া দরকার,...’।
‘ভ্রমণ’ কাব্যগ্রন্থের ‘ভ্রমণ’ কবিতাটির ছোট্ট একটা অংশ। টানা গদ্যে লেখা।
“তারপর ভোর হয়। সবাই জিজ্ঞেস করে – কখন এলে? কি ক’রে এলে? কোথায় ছিলে?
প্রতিদিনের মত বলি – আমি তো আসি না। আমাকে নিয়ে আসে। আমি তো দরজা খুলি না। খুলে
যায়। আমি কাউকেই কিছু বলি না। বলা হয়ে যায়।”
টানা গদ্যের অনেক কথার মধ্যেও পরিমিতি বোধ ঈর্ষনীয়। একটি শব্দও বাদ দেওয়া
চলে না, এমনই ঘণ। ঘটনার পরম্পরা নয়, একটা আবহ সৃষ্টি আর তা থেকে কবিতার উৎসার।
ঘটনার মধ্য থেকে উঠে আসা সংবাদ প্রবনতাকে বাতিল করার ক্ষমতা, খানিকটা
নৈর্ব্যক্তিকতায় বাকিটা মিততায়। ভাবের ঘোর বা আবেগের আতিশয্য কিছুই এখানে নেই।
এখানে কবিতা ‘সংযমী সাধনার ফল’।
এ সবই তাঁর সিগনেচার, যা দিয়ে স্থান আর কালের দূরত্ব ঘুচিয়ে তাঁকে চেনা
যায় আইডেন্টিফাই করা যায়। একটু হলেও আমার কাছে চলে আসেন। এ বিষয়ে খুব সচেতন ও
সতর্ক ছিলেন তিনি। নিজে বিশ্বাস করতেন ও প্রবলভাবে চাইতেন, কবিতা পড়লেই যেন পাঠক
বুঝতে পারেন তিনি সজল বন্দোপাধ্যায়ের কবিতা পড়ছেন। একজন পাঠক হিসেবে বলতে পারি,
তিনি সফল হয়েছেন।
সব শেষে আরেকটি কবিতা তুলে ধরি। প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলা
কবিতা উৎসব/ ডিসেম্বর-২০০৫’এ।
মিড় ঃঃ সজল
বন্দোপাধ্যায়
১
তুমি আমার দিকে তাকাও না –
তুমি মোমবাতির দিকে তাকিয়ে দেখ –
তুমি আমার দিকে তাকাও না –
তুমি মোমের শিখার দিকে তাকিয়ে দেখ –
তুমি আমার দিকে তাকিও না –
তুমি বরং একদিন ছাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখবে।।
মৃত্যুচেতনার কত কবিতাই না পড়েছি। অনেক ভুলে গেছি। আবার
অনেক কবিতা ভেতরে রয়েই গেছে। এই কবিতাটির স্থানও আমার ভেতরেই রইল।
যতদূর মনে পড়ে দিয়ে শুরু করেছিলাম। শেষ করতে চাই যতদূর
বাংলা কবিতা পড়েছি অনুভব করেছি যুক্ত হয়ে পড়েছি তাতে অগ্রজ কবিদের মধ্যে অনেকের
সঙ্গে আমার নৈকট্য আছে দুদিক থেকে। কাছের মানুষ, কাছের কবি। সু্যোগ থাকা সত্তেও
কবি সজল বন্দোপাধ্যায় হয়ত মানুষ হিসেবে ছিলেন আমার যথেষ্ট দূরের কিন্তু কবি হিসেবে
তিনি দূরের নন, বরং বেশ কাছের।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment