Wednesday, July 6, 2016
ছবি আঁকা বা ভাস্কর্য গড়া এবং শিল্পকলার আগ্রহী দর্শক যে কেউ হতে পারেন
দাদা, কেমন হয়েছে এটা ?
তাকিয়ে দেখি আমাদের ফ্রেমার (Framer) মিন্টু ডিম্বাকৃতি চিত্রপট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর ওর পুঁচকে শাগরেদ
হেসে আক্ষরিক অর্থে লুটোপুটি খাচ্ছে। বেশ
খানিক অবাকই হলাম, আসলে যেখান থেকে আশার কিরণ দেখার সম্ভবনা
বিন্দুমাত্র থাকে না সেখানে একচিলতে রোদ
... । চিত্রপটটি আসলে ড্রিপ্রিং (dripping) পদ্ধতিতে
আঁকা অর্থাৎ তুলি ক্যানভাসে স্পর্শ করবে না, পাতলা করে রঙ
গুলে ক্যানভাসটি মেঝেতে রেখে উপর থেকে তুলি দিয়ে ছিটিয়ে ছিটিয়ে ছবি আঁকা হয়ে থাকে।
সম্প্রতি এই ধরনের শিল্পকর্ম কলিকাতার দুটি শিল্প-মহাবিদ্যালয়ের শেষবর্ষের
একশ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা ব্যপকহারে সৃষ্টি করে থাকে। চিত্রকলার কোনরূপ
প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ নেই মিন্টু আর তুলিও ধরে কেবলমাত্র ফ্রেম রঙ করার জন্যই,
স্বাভাবিক ভাবেই এই ছেলের হাত দিয়ে একটি শিল্পকর্মের জন্ম ... অবাক
হওয়ারই কথা। আরো অবাক সাগরেদের কার্যকলাপে, সে এটাকে
হাস্যরসের উপাদান হিসাবেই দেখছে ... আর আমার ভাবনার উপাদান সরবরাহ করছে।
শিল্পকলা নিয়ে এইসময়ের সাধারণের আগ্রহ মিশ্র। কেউ কাগজে
শিল্পকর্মের নিলামের দাম শুনে স্থির করেন এর গুনগত মান, কেউ বা পত্রিকার অলংকরণ, আর একটু ভাগ্যবান হলে
নিঁখুত প্রতিকৃতি। জনগণের অতি সামান্য অংশই প্রবল বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায়
একাদেমি অফ ফাইন আর্টস (কলিকাতা) এ আসেন অথবা সোশ্যাল মিডিয়ার আমাদের মতন
শিল্পীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। বাকিরা নাটক,গান,
নাচ, কবিতা পাঠের আসর, সিনেমায়
বেশি স্বচ্ছন্দ। দুর্ভাগ্য বেশি হলে রাজনীতি বাদানুবাদ অথবা টিভিতে ক্রিকেট বা সোপ
অপেরায় মগ্ন। কিন্তু দোষটা বোধহয় একা
দর্শকের নয় ... কেন দর্শকের নয় তা নিয়ে পূর্বের প্রবন্ধে আলোচনা করেছি তাই
বিস্তারে যাচ্ছি না আর। সোস্যাল মিডিয়ার দৌলতে আমাদের আবার সুযোগ এসেছে দূরত্ব
ঘোচানোর, তাই আমার মনে হয় শুরুটা শিল্পীদের দিক থেকেই হোক
না। একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে ছবি বা ভাস্কর্য দেখা শুরু করা হয়েছে ... দেখা শুরু
হলে আরো আরো নতুন দৃষ্টিকোণ আবিষ্কারের সম্ভবনা রয়েছে।
কালিঘাট পটের সেই বহুচর্চিত ছবিগুলি (মোহন্ত-এলোকেশী, পটের বিবি, ফুলবাবু, বেড়াল
তপস্বী) মনে আছে, যেগুলিতে সামাজিক ভ্রষ্টাচারের টানাপোড়েনের
নগ্নরূপ সরাসরি তুলে ধরা হয়েছিল।
অ্যাক্রিলিকে আঁকা পরিতোষ সেনের এই ছবিটি তার উপযুক্ত উত্তরসূরী।
চিত্রকল্পে আমার পাই দুইজন প্রায় নগ্ন সাধু ব্যাঘ্রচর্মের উপর বসে আছে, পাশে ত্রিশূল। দেহে অত্যাধিক মেদের উপস্থিতি তাদের ভোগের অভ্যাসকে চিহ্নিত
করে। সেই দেহেই ভস্ম মেখে বাহ্যিক সাধুভাব আনার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। পিছনে অবস্থিত
সাধকের হাতে ধরা কল্কে তাদের নেশাগ্রস্থ জীবনের প্রতীক। সামনের সাধক যার এই জগতের
মোহমায়া থেকে মুক্তি ঘটার কথা সে মুঠোফোনে জৈবিক চাহিদায় ব্যস্ত ... উত্তর
অভিব্যক্তিবাদী এই ছবি আমাদের অন্তঃসার -শূন্য আধ্যাত্মিক চেতনার কথা ব্যক্ত করে।
গাঢ় কালো
পশ্চাদপটের সামনে এক লুপ্তকেশ ব্যক্তির সিগারেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ... ছবি ব্যস
এতটুকু। শিল্পী যোগেন চৌধুরী, সময়কাল একটু ধন্ধের (এক জায়গায়
১৯৭৪ অন্য জায়গায় ১৯৭৬), যদিও ছবিটির জন্মস্থান দিল্লীর
রাষ্ট্রপতি ভবনের স্টাফ কোয়াটার্স। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে খদ্দরের চাদর
ব্যক্তিটির রাজনৈতিক পরিচয় এবং চশমা অভিজ্ঞতাকে
নিশ্চিত করছে। হাতের মুঠোর মধ্যে সিগারেট রাখার ভঙ্গি যেন যে কাউকে পিষে
ফেলার ক্ষমতা রাখে। চলে আসি মুখমন্ডলের গঠনে। সাধারণত যে দৃষ্টিকোণ (eye level)
থেকে আমরা দেখতে অভ্যস্থ , তার থেকে সামান্য
নিচে থেকে দেখিয়েছেন শিল্পী। ফলে চরিত্রটির
নাকউঁচু ভঙ্গিমা, দৃঢ় চোয়াল, কানের
পেশি দর্শকের চোখে সহজেই ধরা দেয়। নিন্ম-ঠোঁটের মুদ্রায় অবজ্ঞা ফুটে ওঠে। কাগজের
উপর মিশ্রমাধ্যমে আঁকা বহু চর্চিত এই ছবিটির শিরোনাম 'বিজয়ী
মানুষ'।
প্রতিকৃতি বলতে আমরা ঠিক কি বুঝি। সাধারণ দর্শকের ধারণা
মতে হুবহু ফোটো-ফিনিশ জাতীয় কিছু। তাহলে তো যে কোনো ক্যামেরাই যথেষ্ট এই কাজে, শিল্পীর কিবা প্রয়োজন ??? শিল্পী প্রতিকৃতিতে গড়েন
মানুষটির চরিত্রের নির্যাস, এখানেই শিল্পী অনন্য। শিল্পীমহলে
আক্ষরিক অর্থে রাগী অথচ রসিক বলে পরিচিত চিত্রশিল্পী পরিতোষ সেন মহাশয়
আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছেন প্রচুর ... এইরকম একজন শিল্পীর প্রতিকৃতি ব্রোঞ্জে রূপান্তর
করা চ্যালেঞ্জ বিশেষ। এই অসম্ভব কাজটি সম্ভব করেছেন ভাস্কর তারক গড়াই মহাশয়। মোটা জুলফি, থুতনি অথবা
ভ্রুর ভাঁজে পাই রসের মজা অথচ চোখদুটিতে ফুটে উঠেছে এক আবেগ সমৃদ্ধ ভাবুক।
একটি মুষ্টিবদ্ধ পুতুল ফুলের ঝোপের উপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে
আর একটি হাত সেই পুতুলটিকে স্পর্শ করে আছে ... ছবি দেখার শুরুতে চোখটি এখানেই আটকে
যায়। একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ওই ফুলের ঝোপের মধ্যে দিয়ে দুটি পা
বেড়িয়ে আছে, যার অবস্থান বৈশিষ্ট্য আমাদের মৃতদেহের স্মৃতি
জাগ্রত করে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় ওড়না ঢাকা এক সদ্য কৈশোর উর্ত্তীণ যুবতীর নিশ্চল
ধর্ষিত দেহ যার এখন পুতুল আর ফুলের সঙ্গে সহবাস করার কথা ছিল। চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে গ্রামের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের
মানুষ, এখন আছেন। এই প্রতিবাদী চরিত্রে্র রূপকল্প তাই
হতবাক গ্রামবাসী এখানে গোষ্ঠীবদ্ধ দেওয়ালে রূপান্তরিত হয়েছে, যুগের লাঞ্ছনায় তাদের টলাতে পারে নি। প্রণব ফৌজদারের শিল্পকর্ম দেখতে অভ্যস্ত দর্শকদের কাছে হয়তো এই রচনাটি
বিষ্ময়কর কারণ 'কামদুনি'র মতন সাম্প্রতিককালের
ঘটনা নিয়ে শিল্পীর নির্মাণ ।
স্নানঘরে কাঠের বেঞ্চের উপর বসে আছে এক নগ্ন যুবতী, একপাশে জলের
গামলা অপর পাশে সাবান। ঠিক পিছনেই যে জানালাটি খোলা রয়েছে সেটি তার স্মৃতিতে নেই
এতটাই বিভোর সে, হয়ত প্রেমিকপ্রবরের স্বপ্নে আচ্ছন্ন। সেই
জানালায় উপস্থিত এক যুবকের হতবাক অর্ধাংশ মুখ। না দৃষ্টিতে যৌনতা নেই আছে হতবাক
আচ্ছন্ন পুলক। সমাজজীবনে এই ধরণের ঘটনা প্রায় ঘটে কিন্তু তা নিয়ে চিত্রকল্প সৃষ্টি
... এটা বেশ আশ্চর্যের। ছবিটির রচনাভঙ্গিও চমৎকার, একাধিক
দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা চিত্ররূপ একটি চৌকো ক্যানভাসের মধ্যে গড়ার মধ্যে যথেষ্ট
মুন্সিয়ানার প্রয়োজন। নগ্নতা থাকলেও কোথাও যৌন-সুড়সুড়ি দেবার প্রবণতা নেই শিল্পীর।
প্রসঙ্গত জানাই শিল্পীর নাম, দেশ, কাল,
মাধ্যম অজানা কিন্তু তাতে রসাস্বাদনে বাধা হয় না।
কৈশোরের স্মৃতি আমাদের সবারই মধ্যে আছে, সেই স্মৃতি থেকে প্রকৃত শিল্পীর পরিণত বয়সে জন্ম নেয় এক অনন্য চিত্রকল্প।
চিত্রপটের ঠিক মাঝখানে একটি কিশোর
উপস্থিত। মাথায় কলা পাতা, এই কলাপাতার অবস্থান
শিল্পীর প্রদেশকে নির্দেশ করছে, কারণ বর্ষাকালে ছাতার বিকল্প
হিসেবে এই বাংলায় আমাদের স্মৃতিতে আসে কচুপাতা, কলাপাতা-স্মৃতিটি
কেরল ভূমিপুত্রের।সেই অনুভবকে প্রাসঙ্গিক করছে পরণের লুঙ্গিটি। কিশোরটি বর্ষায় মাছ
ধরে ফিরছে , রাস্তার জলে ভাসছে কাগজের নৌকা। দুটি বিড়াল তার
পাশে মাছের জন্য ঘুরঘুর করছে। আকাশে মেঘের আলংকরিক চিত্ররূপ স্থানীয়
দেওয়ালচিত্রের অনুভব আনে। একধরণের
স্মৃতিনির্ভর আমোদকেই উপস্থাপনা করেছেন শিল্পী রাজীব নায়ার।
ব্যক্তিগতভাবে শিল্পী মনে করেন মোবাইল / সেলফোনকে
প্রতীকে(symbol)
রূপান্তর করা যায় না আধুনিকতার চিণ্হ/লক্ষণ হিসাবে। এর সম্ভাব্য
কারণ হল সেলফোনের ক্রমাগত রূপ(design) পরিবর্তন।প্রতীক
হিসাবে নির্বাচন হওয়া উচিত এমন কিছু যার
দৃশ্যগত স্হায়িত্ব বর্তমান। ‘ libido of Babu’ নামক
টেম্পারায় আঁকা ছবিটিতে প্রতীক নির্মাণ হয়েছে মাছ এবং ইন্দ্রলুপ্ত ব্যক্তির
মুখমণ্ডলের উপরার্ধটি নিয়ে। ইন্দ্রলুপ্ত সাধারনত মানুষের মধ্যবয়স থেকে শুরু হয় তাই
এর প্রতীকি তাৎপর্য রয়েছে অপরদিকে ছুঁতে পারা বা না পারা মাছের সঙ্গে জড়িয়ে আছে
অবরূদ্ধ লিবিডো তাড়না। আবার ‘বাঙালী ও মাছ’ ভারতীয় সংস্কৃতির একপ্রকার মিথও বটে।
হঠাৎ করে অর্থ আগমনে একশ্রেণীর বাঙালীর দেখনদারী বৃদ্ধি পেয়েছিল কোম্পানী
আমলে। সেইথেকে এনাদের চিণ্হিত নামকরণ হয় বাবু বলে।বর্তমান প্রজন্মের NRI, ব্যবসায়ী,ঠিকাদার,রাজনৈতিক নেতা,অভিনেতা থেকে শুরু করে কলেজের অধ্যাপকরাও এই গোষ্ঠীভূক্ত। বাজারে গিয়ে
সেরা মাছটি দরদাম না করে কিনে ফেলে নিজের লিবিডোর পরিতৃপ্তি এবং অপর বাবুদের
লিবিডো চরিতার্থ না করতে দেওয়ায় sadist আনন্দ আজ একইসঙ্গে
মিথ এবং সমকালীন।
আলোচনার শুরুতে
যে শাগরেদটির কথা বলেছিলাম সে বয়সে নবীন তাই শুরুর আলোচিত ছবিটিকে তার শুধুমাত্র
ছেটানো রঙ বলে মনে হচ্ছিল। মিন্টু, যে এই কাজটি করেছে সে
কোনোদিন জ্যাকশান পোলার্ক এর নাম পর্যন্ত শোনে নি, যিনি এই
ড্রিপিং পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করেছিলেন। ডিম্বাকার কাজটি তো প্রমাণ করছে যে সে সফল।
কিন্তু কিভাবে ... ? আসলে মিন্টু বহুবছর ধরে ছবি বাঁধাই করছে,
ছবি পৌঁছাতে প্রায় ওকে বিভিন্ন গ্যালারী আর কলেজে ঘোরা-ফেরা করতে
হয়। ছেলেটি সৎ,বিনয়ী,পরিচ্ছন্ন,
পরিশ্রমী, নিয়মানুবর্তী এবং ঠান্ডা প্রকৃতি।
ফলে ওর দেখার চোখ অবচেতনে তৈরি হয়ে গেছে। ছবির মধ্যে যে অন্তর্নিহিত ভারসাম্য থাকে
... সেটা ও শিখে ফেলেছে। তার ফসল এই ছবিটি। কিন্তু ওর সাগরেদটার সেটা হয় নি ফলে ওর শিল্প দেখে গড়াগড়ি খাওয়া ছাড়া কোনো উপায়
থাকছে না যদি না ও মিন্টুর পথ অনুসরণ করে।
অমিত বিশ্বাস
কৃষ্ণনগর
২৫/০৬/২০১৬
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment