Wednesday, July 6, 2016
২৫-শে বৈশাখের আগেই কবি
সজল বন্দ্যোপাধ্যায় চলে গেলেন
আর ক’দিন বাদেই ২৫-শে বৈশাখ। কবি সজল বন্দ্যোপাধ্যায়েরও জন্মদিন। অথচ ১৬-ই এপ্রিল,২০১৬ রাত সাড়ে এগারোটায় তিনি চলে গেলেন।সজল বন্দ্যোপাধ্যায় আমার প্রিয় কবি। আমার পরিচিত একজন।
কিন্তু তিনি যতোটা পরিচিত তার চেয়েও বড় একটা আত্মীয়তা যে তাঁর
সঙ্গে আমার ছিল একথা বোধহয় সজলদাও জানতেন না। ‘বোধহয়’ কথাটা কেটেই দিতে
চাই। অদৃশ্য এই আত্মীয়তার হদিশ তাঁর কাছে থাকবার কোনো
সম্ভাবনা ছিল না। এই প্রসঙ্গে সব শেষে বলবো।
বরং বলি আমি এই
মানুষটিকে দূর থেকে কয়েকবার দেখে ছিলাম। জানতাম কিন্তু চেনা
ঘটেনি। সে আমার ছাত্রবেলা। তাঁর কবিতা অবশ্যই পড়েছি। এবং কোনো কবির কবিতা
বই কিনে না পড়লে, ওঁকে পড়া হয়েছে এমন
বোধ আমার কিছুতেই জাগতে চায় না। কেমন মন ম্যাজ ম্যাজ করে। সুতরাং তাঁর একাধিক বই কিনেই পড়েছিলাম। ‘ভ্রমণ’ নামে একটি বই জলপাইগুড়ি থাকাকালীন
উপহার পেয়েছিলাম, এমনও আবছা মনে পড়ছে। তবে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ ট্রেনে। সজলদা সস্ত্রীক আর একজন কমবয়সী
ফুলপ্যান্ট আর শার্ট পরা ভদ্রমহিলার সঙ্গে, দার্জিলিং অঞ্চল ঘুরে কলকাতা ফিরছিলেন, দার্জিলিং মেলে। আমি তখন অধ্যাপনাসূত্রে জলপাইগুড়ি। আমিও ফিরছি কলকাতায়। একই জায়গায় আমাদের বার্থ পড়েছিল। কতো আলাপ। কতো গল্পগুজব। পাহাড়ে বসে তিনি যে সব কবিতা লিখেছিলেন, তাও আমাকে পড়ে শুনিয়েছিলেন ট্রেনের কামরায়। কী অপূর্ব সেই অনুভূতি। ভাবলেই চোখের সামনে ট্রেনের কামরাটা
জীবন্ত হয়ে উঠছে।
এ সব অনেক কাল আগের
কথা। তখন দূর পাল্লার ট্রেনে সিগারেট খাওয়া চলতো। আর ঐ যে ফুল প্যান্ট আর শার্ট পরা যুবতীর কথা বললাম—তখন মেয়েদের এই ধরনের পোশাক-আশাক পরবার ততোটা
চল ছিল না। মেয়েদের মধ্যে সিগেরেটের প্রচলনও তখন কম ছিল। তাই ভদ্র মহিলাকে আমার বেশ মনে
আছে। গম্ভীর প্রকৃতির ঐ মহিলা প্যাকেট বার করে ঘন-ঘন সিগারেট খাচ্ছিলেন। আমি আর সজলদাও ধূমপান
করেছি, তবে তাঁর মতো নয়।
কবিতা বিষয়ে
অনেক আলোচনার মধ্যে ভ্রমণ প্রসঙ্গ আসছিল।সজল বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করতেন কবির জীবনে
ভ্রমণের একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। কিন্তু অনেক কবির একটা ট্র্যাজেডি এই যে
তাঁরা সব সময় তাঁর মনের মত জীবনসঙ্গী খুঁজে পান না। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ভ্রমণ
পছন্দ করছেন এমন অনেক সময় কবিদের জীবনে ঘটে না।
পরবর্তীকালে
আমরা প্রতিবেশী হয়ে উঠি। গলফ গ্রীনে। কী মজার কথা, রাস্তায় দেখা ও কথাবার্তা হলেও আমরা কেউ
কোনোদিন কারও ফ্ল্যাটে যাইনি। যাবো যাবো করেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি আমার ক্ষেত্রে। আজ
খারাপ লাগছে।
সজলদা আমাদের দার্জিলিং মেলের সেই সেশনটিকে বড় গুরুত্ব
দিতেন। পরের দিকে তাঁর শরীর ভাল যাচ্ছিল না।
দেখা হলেই বলতেন আর একটা বই-ই আমি শুধু বার করে যেতে চাই। এটাই হবে আমার শেষ
কবিতার বই। আর বলতেন- কীভাবে সময় কেটে যায়! সেই দার্জিলিং মেলে আপনার সঙ্গে দেখা হওয়া- সে আপনার দুরন্ত যৌবনের দিন,
আমি মাঝ-বয়সী। আজ আপনি মাঝ-বয়সী আর আমি প্রায়
শেষের মুখে। অথচ মনে হয়, এই সেদিন তো আপনার সঙ্গে
প্রথম দেখা হয়েছিল!
এবার সজল দার সঙ্গে আত্মীয়তার কথাটা একটু খুলে বলি। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে দাপিয়ে রাজত্ব করছি। একবার দল-বল নিয়ে গেলাম সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে, তাদের প্রতিযোগিতামূলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। বন্ধুদের চাপে নাম দিয়ে বসলাম ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রতিযোগিতায়। দেওয়ালে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল ধূসর বর্ণের মা ও ছেলের ছবি। সেটাই সেদিনের প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তু। কানাঘুষো খবর পেয়েছিলাম, বিচারক থাকবেন, প্রখ্যাত কবি সজল বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি ‘শ্রুতি’ আন্দলনের খবর রাখি। পরেশ মণ্ডলের ‘মান মন্দির’ বইটি পড়েছি মুগ্ধ হয়ে। সজল বন্দ্যোপাধ্যায় কবিতার সঙ্গেও আমার খুব ভাল যোগাযোগ ছিল। কাজেই বুদ্ধি খাটিয়ে তাঁদের টেকনিকে একটি কবিতা লিখে সেদিন জমা দিয়ে ছিলাম। সে লেখার ছিরি দেখে পাশে বসে থাকা অন্য প্রতিযোগী বন্ধুরা বাঁকা চোখে তাকিয়ে ছিল। আমারও আশা ছিল না। কিন্তু চারদিক থেকে খবর আসতে শুরু করল আমি ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রতি্যোগিতায় প্রথম হয়েছি। পুরস্কার বড় কথা নয়, পুরস্কার আমার জুটতো। তবে তা বিতর্ক, বক্তৃতা, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা ইত্যাদি বিষয়ে।
ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রতিযোগিতায় নতুন টেকনিকে কবিতা লিখে এই প্রথম হওয়া, কবি হিসেবে আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। বুঝেছিলাম কোনো আন্দোলনকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারলে সেই আন্দলনের প্রবক্তাদের কাছে গুরুত্ব অবশ্যই পাওয়া যাবে। কবি সজল বন্দ্যোপাধ্যায় আমার প্রথম যৌবনের স্পর্ধা ও আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এমন তীব্র ভাবে যে তাঁকে আমি আত্মীয় ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারিনি কোনোদিন ।
আমি কখনো কোনো সাহিত্য আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হইনি। ভুল বললাম, একবার যুক্ত হয়েছিলাম, ‘দলিত সাহিত্য আন্দলনে’।প্রখ্যাত সাহিত্যিক কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের আহ্বানে। কিন্তু যে কোনো সাহিত্যিক আন্দোলনের খবর আমি নিতান্ত ছেলেবেলা থেকেই রাখতাম। এখনো রাখি। সাহিত্যে কোনো আন্দোলন হয় কি হয় না, এই তর্কের মধ্যে না গিয়েও বলবো এই সব আন্দোলন থেকে আমাদের কিছু অমূল্য প্রাপ্তি অবশ্যই ঘটে। কবিতার ক্ষেত্রে যা আমার ঘটেছিল শ্রুতি আন্দোলনের আঁচ লেগে,
কবি সজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেপথ্য অনুপ্রেরণায়। তাই আজ স্বীকার করবো তাঁর সঙ্গে আমার আত্মীয়তার শেকড় পোঁতা আছে আমার প্রথম যৌবনের মাটিতে।
প্রথম দিকে সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া শ্রুতি আন্দলনে যুক্ত কোনো কবিকে আমি প্রত্যক্ষভাবে চিনতাম না। আগে বলেছি, আবার বলবো, ‘মান মন্দির’ বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতার
বই। এইসব শ্রুতি কবিরা কথা বলবার একটা নতুন ভঙ্গি তৈরি করেছিলেন। শব্দের অপচয় কমিয়ে এনেছিলেন তাঁদের কবিতায়। অনেক ক্ষেত্রে কোনো বাক্য নয়, শুধুমাত্র কয়েকটি শব্দের ইঙ্গিতে অনেক বড় বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারতেন এই কবিরা। পরে ফরাসী ভাষা চর্চা করতে গিয়ে দেখেছি কথা বলবার এই ভঙ্গি শ্রুতিকবিদের সম্পূর্ণ নিজের ছিল না। অ্যাপলেনিয়র, প্রেভর এঁরা অনেক আগেই এই কৌশল আয়ত্ত করেছিলেন। কিন্তু বাংলা কবিতার গতানুগতিক ধারায় এঁদের কথা বলবার ভঙ্গি আমার চমৎকার লেগেছিল। আমাকে বেশ টেনেছিল। এখনও টানে।
কবিতা লিখতে লিখতে এতোদূর চলে এলাম?
প্রিয় কবি পরেশ মন্ডলের সঙ্গে একবার দেখা হল উত্তম দাশের ‘মহাদিগন্ত’
স্টলে, বই মেলায়! এক সময় পুষ্কর দাশগুপ্ত হয়ে ওঠেন আমার মধ্যরাতের বন্ধু। আমি তখন বালিগঞ্জে থাকি। আমার ঘরে রাত ১১টার পরে আড্ডা শুরু হত। কিন্তু... সজল বন্দ্যোপাধ্যায় আমার কাছে চিরকালই আলাদা একটি মানুষ। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি ব্যাক্তিত্ব।
জানি সব চলে যাওয়ার মতো এ যাওয়াও গা-সওয়া হয়ে যাবে কিন্তু সজলদার মৃত্যুর খবর পেয়ে এখনো মনে হচ্ছে কি যেন একটা নেই-কে যেন একটা চলে গেল-তাকে আর ফিরে পাবো না কোনোদিন।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment