Wednesday, July 6, 2016
পাণ্ডুরলিপি
এখন ভাবতে অবাক লাগে যে আমাদেরও একটা ছোটো বেলা
ছিল। মানে, লেখার
ছোটো বেলার কথা বলছি আরকী। সে সময়টা দীপাঞ্জন দত্ত একটা কাগজ করতেন নাকতলা থেকে।
আবর্ত। রবিবারের সকালের আড্ডাগুলোতে আমি যেতাম মাঝে মাঝে এই আবর্তের আড্ডায়। অবাক
হয়ে শুনতাম নতুন সব লেখা। আশ্চর্য সব কবি লেখকদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম
আমি কেন যে লিখতে পারিনা ওরকম। তো সেখানেই দেখা এক আশ্চর্য কবি প্রবীর রায়ের সাথে।
তখন সবে তার বই ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ বেরিয়েছে
আবর্ত থেকে। সে বই হাতে নেওয়াই তো এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা তখন। তারপর তার সাথে আলাপ
হল। তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন-‘চলো তোমাকে এক কবির
কাছে নিয়ে যাই। চেনো সজলদা কে?’ আমি তখন ভাবছি ছি ছি আমার
তো চেনা উচিৎ ছিলো। এদিকে তার নাম আমি শুনিনি তখনো। মুখ লাল করে বললাম –‘না, চিনি না।‘ কথা না
বাডিয়ে প্রবীরদা বললেন ‘চলো আলাপ করবে’। আমিও চু্পচাপ চললাম তার পিছু পিছু।দীপাঞ্জন
দত্তর বাড়ি থেকে হাঁটা পথই হবে সেই বাড়ি। ‘সজলদা আছেন’ –বলে দরজা ঠেলে ঢুকলেন প্রবীরদা।
আমি ফাউ হিসেবে তার পিছু পিছু। দরজা সম্ভবত খোলাই ছিলো। নাকি এসে তিনি খুলেছিলেন
এখন মনে পড়ছে না। এরপর যেটা মনে পড়ছে সেটা হল সজলদা একটা খাটে টান টান শুয়ে। খালি
গা পরনে সিল্কের একটা ছাপা লুঙ্গি। আরেকটা কোলবালিশ বুকে জড়ানো। শুয়ে শুয়েই
কথা চলল প্রবীরদার সাথে। আমার দিকে তাকালেন একবার হেসে। ব্যাস ওইটুকুই স্মৃতি
প্রথম দিনের। তখন কি তাঁর শরীর খারাপ ছিলো? হতে পারে।
এতদিন পর আর সেটা মনে নেই। তবে ওই কোলবালিশ জড়িয়ে তাঁর ওই নিশ্চিন্ত কথা বলার
স্টাইল আমাকে মোহিত করেছিলো। জামা পরার জন্য উতলা হতেও দেখিনি তাঁকে। মানে যেন আমি
তো এরকমই, শব্দের কাছে নতজানু শুধু। এতদিন পরেও তাই
স্পষ্ট মনে আছে আমার। ৩৬ বছর সময়টা কম নয় বোধহয়। কারণ ‘ম্যাজিক
লণ্ঠন’ বেরিয়েছিল আবর্ত থেকে ১৯৮০ সালে।
আমি গান গাই।
আমি নেশায় ডুবি।
আমি অভিমান করি।
আমি ঘর বন্ধ করি।
আমি লুকিয়ে চোখ ধুয়ে ফেলি।
হাঁ,
আমি যা পারি, তা পারি।
আমি যা করি,
তা জেনেই করি।
আমি আমার কথা, আমার ভাষায় আমার জন্যে,
হয়তো বা আমার মত অন্য কারো জন্যে,
রেখেই যাচ্ছি।
সেই প্রথম দেখা হওয়ার পর বহু বছর কেটে গেল। সবার
মত আমিও জীবন যুদ্ধে কাটিয়ে ফেলি প্রায় আট দশটা বছর। প্রথমে চেন্নাই তারপর
মুম্বাই। তারপর সব ছেড়ে ছুড়ে কলকাতায় গেড়ে বসতে আরো কিছু সময় চলে গেল যে কীভাবে তা
আমি টেরও পাইনি। কারো সাথেই তাই যোগাযোগ ছিলোনা তখন। শুধু সাথে সাথে ছিলো নানারকম
বইপত্র। কলকাতায় ফিরে আসার পর আবার শুরু হল সব। একদিন এক সকালের ঘটনা মনে পড়ছে
আমার। শঙ্করদা মানে শঙ্কর ব্রহ্ম তখন কালকুটা নামে একটা কাগজ বার করতেন।
বাংলা-জার্মান ভাষায় খুব সম্ভব। তো গলফগ্রিনে তার বাড়িতে একদিন গেছি দল বেঁধে। সে
দলে শর্মী, ধীমা্ন
ছিল, রতনও কি ছিল? এখন মনে পড়ছে
না ঠিক। দেখি সজলদা একটা হারমোনিয়াম নিয়ে জমিয়ে বসেছেন। কিছুক্ষণ আড্ডার পর সজলদা
শুরু করলেন গান। সে গান যে না শুনেছে সে জানতেই পারবেনা কী ভালো গান গাইতেন সজলদা।
কয়েকটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের পর শুরু হল নিধুবাবুর টপ্পা। পরে জেনেছি নিধুবাবুর টপ্পা
ছিল সজলদার বড় প্রিয়। এখনও মাথায় গেঁথে আছে সেদিনের গাওয়া –‘এত গয়না বেটি কোথায় পেলি’... গান খানি। আগে
কখনো শুনিনি। এবং তার পর থেকে প্রিয় হয়ে উঠেছিল আমাদের কাছে। প্রথম সুযোগেই গানের
ক্যাসেটটা কিনে ফেলা, তারপর সারাক্ষণ সেটা সোনা। তখনো
জীবন এত কঠিন হয়ে যায়নি। সবার বাড়িতেই একটা করে ছোটো বড় ক্যাসেট প্লেয়ার থাকতো,
ফোন কানে গুঁজে চালাতে হয়নি। তো সেই গান আমার সুরহীন হেঁড়ে গলায়
কতজন কে যে শুনিয়েছি তার ঠিক নেই। আরেকটা গান কণিকার –‘সে
যে মানে না মানা’। উফ সে এক ঘোর বটে যা আমার এ জীবনে কাটবার নয়। তারপর কতজন এই
গান শুনিয়েছেন আমাকে অবশ্যই আমার অনুরোধে,
কিন্তু সজলদার মত কেউ পারেন নি নাড়িয়ে দিয়ে যেতে। আমি জানিনা এর
রহস্য কী। আমি তো কখনো গান শিখিনি শুধু কানই ভরসা আমার। তার ভালোলাগা টুকু। আর
চিরকালের পেটুক আমি মনে রেখেছি শঙ্করদার স্ত্রীর বানানো স্প্যানিশ অমলেট। সেদিন
স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তা নেমে এসেছিল গলফগ্রিনে। এখানেই তো, এখানেই তো মনে মনে ভাবছিলাম আর খাচ্ছিলাম সেই মহার্ঘ অমলেট। সেখানে
কবিতা পড়বার মত অশ্লীলতা কি করেছিলাম আমরা? মনে পড়ছেনা
ঠিক। ভাগ্যিস খারাপ কথা মনে রাখতে নেই, থাকে না কারোরই।
এরকম কাছাকাছি সময় জলপাইগুড়ি থেকে কয়েকজন তরুণ
প্রকাশ করলেন ‘এরকা’। সেখানেই প্রকাশিত হল সংহত কবিতার ম্যানিফেস্টো। সজলদার কবিতার যে মিনিমালিস্টিক
অ্যাপ্রোচ তাকেই যেন আরো প্রতিষ্ঠিত করল এই আন্দোলন। শ্রুতি আন্দোলনের পর এই কবিতা
আন্দোলনের দিকে আমরা নজর রাখছিলাম। প্রবীরদা আর সজলদা কে আরেকবার নতুন করে পড়তে
যেন উৎসাহ যোগাচ্ছিলেন ওরা। ততদিনে আমরা গ্রাফিত্তি থেকে অতীন্দ্রিয় পাঠকের কয়েকটা
বই করে ফেলেছি। আমরা চাইছিলাম সজলদার একটা বই করতে। অতীন্দ্রিয়দা কে অনুরোধ করলাম
তিনি যদি সজলদাকে রাজী করাতে পারেন। শুরু হল সজলদার সাথে কথাবার্তা। শুধু কবিতা নয়, দৃশ্যত বইটারও একটা মিনিমালিস্টিক অ্যাপ্রোচ
থাক চাইছিলেন সজলদা। আমাদের আর্ট সিরিজের অবলং সাইজ মনে ধরেছিল তার। তিন ফর্মার
একটা ছোটো কবিতার বই। প্রচ্ছদ করেছিলেন শর্মী পাণ্ডে। একটা তীব্র নীল কাগজের উপর
একটা সাদা বক্সের ভেতর বই এবং লেখকের নাম। ব্যাস আর কিছু নেই। সজলদা খুশি হয়ে
হাভানা চুরুট গিফট করেছিলেন শর্মীকে, সেই আমার প্রথম
হাভানা চুরুট খাওয়া। অবশ্যই শর্মীর কল্যাণে। সাথে অবশ্যই সেই আরেক বিশেষ চুরুটের
কথাও মনে পড়ছে যা ধরালে মুখের ভেতর মধু গলে গলে পড়ে। প্রথমে ভেবেছিলাম মেটাফর
বুঝি। তারপর মুখে প্রথম ফোঁটাটা পড়ার পরই লাফিয়ে উঠেছিলাম। কে জানতো এও সম্ভব।
এরকম কবিতার মত চুরুটের সন্ধান তো সজলদার কাছেই থাকার কথা।
‘পাণ্ডু(র)লিপি’ বেরল
গ্রাফিত্তি থেকে। যা পাণ্ডুলিপি এবং পাণ্ডুরলিপি দুটোই একসাথে। শুধু মাঝের ‘র’টা নেমে এসে ঝুলে আছে শিখণ্ডীর মত। আছে অথচ
নেই যেন। তবু তার প্রতাপ কিছু কম নয়। বইটার শুরু এভাবে –
একটি পাণ্ডুলিপি
জন্মের মুহূর্তে
কালপুরুষ মন্ত্র উচ্চারণ করলেন-
পাণ্ডুলিপি হও-
সেই থেকে ভালবাসার হরফ
ঘৃণার দাঁড়ি
খ্যাতির উদ্ধৃতি-চিহ্ন
অপমানের অর্ধ–ছেদ
নিজেই অক্ষরে অক্ষরে ক্ষতবিক্ষত
একটা পাণ্ডুলিপি
আর শেষে একটা সই-
সজল বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৯৯তে প্রকাশিত সে বই সে বছর বইমেলাতে প্রচুর
বিক্রি হয়েছিল। হওয়ারই তো কথা। ভালো বইয়ের জন্য পাঠক ওঁত পেতে বসে থাকে ঠিকই। আজও।
লোকজন যে বলে কবিতার বই বিক্রি হয় না সে কথা তাই মানি না আমি।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment