Wednesday, July 6, 2016
বঙ্কিমচন্দ্র | অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত
[চতুর্থ পর্ব]
‘সমুদ্র-মন্থনকালে পৃষ্ঠস্থিত
মন্দার-পর্বতের ও অনন্তের ভারে
অভিভূত হইয়া পর্বত-ভারবাহী
কূর্ম দৈত্যগণের মোহনের জন্য এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেই নিঃশ্বাসের কল্লোল
যতদূর গিয়াছিল ততদূর কিলকিলা দেশ।’
—‘দিগ্বিজয় প্রকাশ’, কবিরাম
অশ্রু উপত্যকা
[একই কেন্দ্রের
অভিমুখে যাওয়া এবং তৎসহ একই বিন্দুতে মিলিত হইবার জন্য কাছাকাছি আসা, ইংরিজিতে ইহাকে
‘কনভার্জ’ বলে। বাঙলায়, ‘অভিসারী’। হে কবি, তুমি কি অভিসারে বাহির হইয়াছ? বস্তুত, সিস্টেম কদাপি চাহিবে না ছেলেমেয়েরা একটু কাছাকাছি দূরত্বের ইতিহাস
যথেষ্ট স্মরণযোগ্য ভাবে স্মরণে রাখুক। রাখিলেও, তাহাকে আজকের প্রেক্ষিতে
বিশ্লেষণাত্মক এবং সংশ্লেষধর্মী মেধায় মিলাইয়া নিক, যাচাই করুক। চাহিবে না। আজ যে
সিলেবাসে বস্তুগত এবং নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের বাড়াবাড়ি, তাহাও এই রাজনৈতিক হিসাবেরই
এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্ক ও অংশ। বলা বাহুল্য। হে কবি, তুমি কি অভিসারে চলিয়াছ?
লক্ষ লক্ষ পাখি এখানে, একসাথে ডাকছে। ডাকছে। ডেকেই
চলেছে। বিরাট পাখিবাজার। মনে হবে তুমি একটা পাখিবাজারেই এসেছ। বইমেলার ওই আওয়াজটাকে আর মনেই হবে না এত মানুষের গলা।
সবাই একসাথে কথা বলছে। নানান কথা। মনেই হবে না। বন্ধ চোখের
দুই পাতায় অন্ধকার জমাট হচ্ছে। দুই—চার—আট—দশ মিনিট। একদম বন্ধ। বইমেলায়, রোব্বারের সন্ধ্যায় লোক ঠাসা, চোখ
বুঁজে ফ্যালো।
প্রথম ও একমাত্র প্রশ্ন হচ্ছে খাঁচা খুলে এই পাখিগুলো
ঝাঁপিয়ে পড়বে না তো? এবার তুমি কী করবে, এখন তোমার কী মনে হচ্ছে—এসব কোনও প্রশ্নই
নয়। গোটা মাঠজুড়ে খাঁচায় খাঁচায় পাখি। লক্ষ, কোটি। কিলকিলার শখের মিলনমেলা,
আন্তর্জাতিক কিলকিলা পুস্তকমেলা, এত এত স্টল, টেবিল, লোক, বই, খাবার, সুনাগরিক,
মঞ্চ—সব ফাঁকা। বইমেলা আর নেই। চোখ খুলেও তা-ই দেখা যাচ্ছে। পাখিবাজার।
অথচ, তুমি বইমেলায় এসেছিলে। আজ তোমার বই প্রকাশ।]
‘আপনারা
ব্রিটিশরা বড়ই ন্যায়পরায়ণ। যে-বিশৃঙ্খল অবস্থায় ভারতকে আপনারা পেয়েছিলেন, ঠিক সেই
অবস্থাতেই আবার ফিরিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছেন।’
দেশভাগের
সময় অক্সফোর্ড থেকে আসা জনৈক সমাজকর্মীকে এ-কথা বলেছিলেন পঞ্জাবের এক কর্মকর্তা
কলকাতায় নতুন বাড়িতে এসে ‘তার’ প্রথম কাজ হ’ল কাছাকাছি একটা সেলুন খুঁজে বের করা।
দ্বিতীয় দিনেই ‘সে’ এই কাজটা
সেরে ফেলল। তিনতলা থেকে নিচে নেমে ডান দিকে কমপ্লেক্সের পাশ দিয়ে গলি। গলির মুখে, বাঁ-হাতে, পঞ্চদেবদেবীর মন্দির। শাদা মার্বেল পাথর। গেট বন্ধ। আরও
একটু এগিয়ে লম্বাটে একচিলতে দোকান। লেখা
আছে, নেপচুন সেলুন। তার বাইরে, সিঁড়ির কাছে বড়োসড় এবং
যথেষ্ট প্রবীণ একটি রিভলভিং চেয়ারে
রোগা চেহারার একজন ব’সে শীতের বিকেলে কমলালেবু খাচ্ছেন আয়েস ক’রে, খোসা ছাড়িয়ে
ছাড়িয়ে। দেখে, ডাকতে বিব্রত বোধ হয়। ওঁর আয়েসে ব্যাঘাত আসবে। মুখে না বললেও কষ্ট
পাবেন হয়ত মনে। আশপাশের
দর্জি ও স্টেশনারি দোকানগুলো এখনও বন্ধ। ‘সে’ বরং সিগারেট ধরাক। শীত নেই। তবু শীতের
কাল্পনিক আমেজ নিয়ে আছে লোকজন। ঈশ্বর বিশ্বাসীর ঈশ্বরের মতো। দেখা যাচ্ছে না—দেখা
তিনি দেবেনও না, তবু তো আছেন—এই বিশ্বাসে মিসিং গডকে প্রণাম ক’রে যেতে হয়। শীতও
নেই। অন্তত শরীরে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তবু সে আছে। এই বিশ্বাসে আলমারি থেকে
বেরুচ্ছে হাফ সোয়েটার, মাফলার, মোজা। কেউ কেউ আরও একটু বেশি কল্পনাপ্রবণ হলে ফুল
সোয়েটার, এমনকি জ্যাকেটও। এটাই ভালো। কল্পনাই যখন ক’রে নিতে হচ্ছে, তখন গ্যাংটকের
ঠাণ্ডাই কল্পনা করা যাক, কী? কল্পনা তো হাওয়া অফিসের পরোয়া করবে না। কাল বড়দিন। সন্ত নিকোলাসের উপহারে সাজছে শহর। এমনকি ছুটি হওয়ার আগের
মুহূর্তে ইশকুলগুলিও। ক্রিসমাসের ঠিক আগের দিনই, এ’ বছর আরও একটি ধর্মীয় পরব। সারা
কলকাতা ক্রিশ্চান নয়, তথাপি বড়দিনের আলো তার কম পড়েনি। কিন্তু ফতেহা দোহাজ দহম-এর
খোঁজ সহিষ্ণু হিন্দু-বাঙালি রাখার প্রয়োজন মনে করেনি। পাড়ায় পাড়ায়, দোকানে,
রাস্তায়, বাড়িতে তার কোনও ছায়াও পড়েনি। শুধু সেলুনের বাইরে প’ড়ে আছে কমলালেবুর
খোসা আর সরু সরু আঁশ। সিগারেট শেষ হ’লে, ‘সে’
সেলুনের ভেতর গিয়ে বসে। সামনে
দেয়ালজুড়ে
লম্বা আয়না। র্যাক ভর্তি চুল দাড়ি কাটার বিবিধ সরঞ্জাম। ‘তার’ চোখ গেল অন্যখানে। আয়নার সামনে ক্লীপ দিয়ে A4
মাপের কিছু কাগজ লাগানো। কাগজে বাঙলায় ডিটিপি করা লেখা দেখা যাচ্ছে।
সেলুন থেকে বেরুবার সময় ‘তার’ মনে হয়ত এইরকম একটি
ভাবনা জন্মাবে, যেখানে (হয়ত) ‘তার’ মনে হবে, মানুষের চেতনা, তার ধ্যানধারণা তো তার
শরীরেরই পরিবর্তিত রূপ—একজন মানুষ যেমন তার শরীরকে, অবয়বকে সমর্পণ করে তার সামনে
দাঁড়ানো মানুষটিকে—ঠিক যেভাবে দর্পণের সামনে দাঁড়ানো মানুষ দর্পণের ফ্রেমের মধ্যে
থাকা সবটুকু দর্পণকে সমর্পণ করে নিজের শরীর ও তার অবয়ব—তেমনিই তার চিন্তাভাবনাকেও,
সমস্ত চিন্তাভাবনাকেই যদি সে পারত সমর্পণ করতে, যদি পারত, তাহলে মানুষ নিশ্চিতভাবেই
আর তাস খেলত না। এবং এরকম,
এরকমই একটা ঘর সে খুঁজে পেত।
—‘এটা কী?’
—‘এটা একটা গল্প’
—‘গল্প! কার লেখা?’
—‘আমারই’
—‘আপনি গল্প লেখেন?’
—‘জ্বি’
—‘কবে থেকে লেখেন?’
—‘লিখছি তো সেই ছেলেবেলা থেকে’
—‘কোথাও, মানে কোনও পত্রিকা-টত্রিকায় পাঠান গল্প?’
—‘জ্বি না। লিখে পাশের দোকানে টাইপ করতে দিয়ে দিই। এখানে ক্লীপ
দিয়ে আটকে রাখি তারপর। যারা চুল দাড়ি কাটতে আসে, তারা পড়ে। কারও ভালো লাগলে জেরক্স ক’রে নিয়ে
যায়।’
—‘পড়া যাবে আপনার গল্প?’
—‘জ্বি। কেন
পড়া যাবে না!’
—‘কখন লেখেন আপনি?’
—‘সকালের দিকে খুব ব্যস্ত থাকি। দুপুরের পর থেকে
ফাঁকা। এখানে বসেই লিখি।’
ট্রেনে বাসে
যেতে-যেতে, রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে, ব্রিজে দাঁড়িয়ে ‘আমি’ শুধু দু’চোখ মেলে মানুষ দেখি—দেখতেই
থাকি—মানুষ হাঁচছে, মানুষ নাক খুঁটছে, মানুষ রাস্তা পেরুচ্ছে, মানুষ বাস ধরছে,
মানুষ স্লোগান দিচ্ছে, মানুষ গোগ্রাসে খাচ্ছে, মানুষ টিকিট কাটছে, মানুষ থুতু
ফেলছে, মানুষ দেওয়াল লিখছে, মানুষ ট্যাক্সি ডাকছে, মানুষ পোঁদ চুলকোচ্ছে, মানুষ
চোখ মারছে, মানুষ ঝাঁট দিচ্ছে, মানুষ ভাড়া চাইছে, মানুষ পেচ্ছাপ করছে, মানুষ জানলা
বন্ধ করছে, মানুষ জানলা খুলছে, মানুষ স্নান করছে, মানুষ ফোন করছে, মানুষ মিছিল
করছে, মানুষ গ্রেপ্তার করছে, মানুষ গ্রেপ্তার হচ্ছে। ভাবি, এই যে এত এত
মানুষ ছুটছে দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে, এরা সবাই জীবনে কত জায়গায় কতবার যে বলেছে—‘আমি
কিন্তু…’—এই যে ‘আমি’, আমি-তে জোর দিয়ে যে উচ্চারণ, এরা
বোধয় সবাই করেছে—আমি কিন্তু অন্য ধাতুর জিনিস, সবাই বলেছে জীবনে—ক্ষুরে ব্লেড ভরতে ভরতে ভদ্রলোক
আপন মনে বলেন, ‘কর্তামশাই নিবারণকে বলেছিল, বছরের শুরুতে একটা বড়োসড় ইলিশ
খাওয়াস তো আমারে নিবারণ। আমি বোধয় আর বেশিদিন বাঁচব না।’ সামনের দিকে অনেকগুলো দাঁত না থাকায় মাড়ির সাথে জিভের অবশ্যম্ভাবী ধাক্কা
চোখে পড়বেই। কানেও।
—‘এটা কার লেখা?’
—‘কারোর লেখা না। এমনিই মনে আসলো, বললাম। আমি বেশি কিছু পড়ি নাই। শরৎচন্দ্রের চারটা গল্প পড়েছি। অভাগীর স্বর্গ।
বামুনের মেয়ে। মহেশ। আর চাপাডাঙার বউ। তাও চাপাডাঙার বউ সবটা পড়া হয় নাই। যার বই ছিল, সে নিয়ে গেছে। আর জসিমউদ্দীন পড়েছি। নকশিকাঁথার
মাঠ। আর সোজনবাদিয়ার ঘাট। ব্যস।’
অথচ, নিজের জন্মমুহূর্তের কথা ভাবলে মনে হয়, অন্ধকারে,
একটা মিছিলের ভেতর জন্মেছিলাম, আমি। সন্ধের পর মিছিল শুরু হতেই লোডশেডিং হয়ে যায়।
গরমে হাঁসফাঁস করা পুরুষ, মহিলা ও শিশু হাতপাখা সন্নিবিষ্ট হয়ে বাইরে, রোয়াকে এসে
দাঁড়ায়। তখনই অন্ধকারের ভেতর-ফুঁড়ে মিছিলটা আসে। এবং অন্ধকার বাজিয়ে চলে যায়। সেই মিছিলের ভেতর জন্মাই, আমি।
‘তার’ মনে হয়, ওকে বলবে এখনকার লেখালিখি পড়তে। ইচ্ছে হয়, এখন কী ধরনের কাজ
হচ্ছে বাঙলা সাহিত্যে, গত চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরে কী
কী পরীক্ষা হয়ে গেছে তার সাথে ওঁর
পরিচয় ঘটাতে। তারপর মনে হয়, কী দরকার। কী দরকার ওঁর নিজের
জগতটাকে নষ্ট ক’রে। এই সেলুনের ঘুপচি ঘরের ভেতর ব’সে একটা লোক তো ঘাড় গুঁজে রোজ
বিকেলে খাতা কলম নিয়ে লিখতে বসে। তার পৃথিবীর কথা লেখে। নিজের মতো করেই লেখে। না-ই
বা থাকল তার সাথে এখনকার সাহিত্যের কোনও যোগ। তবু তার পৃথিবীটা তো মিথ্যে নয়।
সেটাকে ঝুটা
প্রমাণ ক’রে কী লাভ। তবুও হয়ত এই লোকটিও জীবনে কখনও রেগে গিয়ে বলেছে,
‘আমি কিন্তু’। জগতে এত এত আমি। কোনও ‘একটা’ আমি তো নেই এখানে...
অথচ আধুনিক সময় ছিল
একটা। যেখানে মানুষ সমগ্র বিশ্ব চেতনাকে অনুভব করত নিজের মধ্যে। বলত, আমাদের
সবচেয়ে বড়ো প্রার্থনা এই যে, আবিরাবীর্ম এধি। হে আবি, তুমি আমার মধ্যে প্রকাশিত
হও। তুমি, পরিপূর্ণ। তুমি, আনন্দ। তোমার রূপই আনন্দরূপ। সেই আনন্দরূপ গাছের
চ্যালাকাঠ নহে। তাহা
গাছ। যেখানে কোটি কোটি অসংখ্য সিলিকন কণা দিয়ে তৈরি হ’ত একটা আরশি। সেই
আরশিটি হলাম আমি। নিজের মধ্যে এক সমগ্রকে খুঁজে পাওয়ার সময় সেটা। তারপর এই নীল
রঙের গ্রহে মানুষ যা যা খেল দেখাল, এল আরেক সময়। যখন সেই আরশিটি গেল ভেঙে টুকরো
টুকরো হয়ে। গাছ পড়ল কাটা। বন গেল হারিয়ে। পশু এল বন থেকে বেরিয়ে। আরশির সব টুকরো
মেঝেতে পড়ল সব ছড়িয়ে। কোনওটা হারিয়েও গেল। এখন, এই প্রত্যেকটা আলাদা টুকরোর আলাদা
অস্তিত্ব ও বাস্তবতা রয়েছে। প্রত্যেকের আছে আলাদা অবস্থান। এই প্রতিটা টুকরোই
কিন্তু এসেছে ওই ‘এক’ আরশি থেকে। আর সেই আরশি এসেছিল কোটি কোটি সিলিকন কণা থেকে।
এখন এই আরশির টুকরোগুলোর মধ্যে তাদের বাপ আরশির এবং ঠাকুর্দা ও পূর্বপুরুষ সিলিকন
কণার বালুকাবেলার স্মৃতিটুকুই আছে। তা-ও ক্ষীণ। বরং তাদের চেতনা আজ পুনর্নির্মিত
হয়েছে। প্রকট হয়ে উঠেছে তাদের টুকরো অস্তিত্ব। যেখানে সে আর নিজের মধ্যে সারা
কসমসকে অনুভব করছে না। বরং সারা কসমসেই সে দেখেছে নিজের আমিগুলোকে ছড়িয়ে যেতে।
দাড়ি কাটা শেষ হ’লে ‘সে’ ব’সে যায় গল্প পড়তে। গল্পের নাম ‘পানিপথে ভ্রমণ’। পড়তে পড়তে থামে। ভাবে। পড়ে।
আবারও ভাবে। মানুষ কোথা থেকে তার অস্তির প্রমাণ সংগ্রহ করে। এই সেলুনে
ব’সে একটি লোক চিন্তা করে। মস্তিষ্কের কোষগুলোকে কাজে লাগায় চিন্তা করতে। মানুষ
এভাবেও থাকে।
কী এই থাকা? থাকা মানে আসলে কী? Cogito ergo sum? এটাই?
রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর
গভীরে। কিন্তু কীভাবে থাকে? একটি তারা যখন অপর তারার জন্য জ্বলে, জ্ব’লে থাকে, আলো
বিকিরণ করে এবং চিন্তা করে। আমরা কেউই জানি না কীভাবে এক অনতিগম্য পদ্মের দিকে জল
বয়ে যায়। ফোয়ারা উঠে দাঁড়ায় প্রতিটি উঠে দাঁড়ানোর অনিবার্য পতন স্বীকার করেই।
এই লম্বাটে ঘরে ব’সে থাকা একটি লোকের মাথা থেকেও আলো
বের হয়। বাঙলা সাহিত্যের বাজার কিংবা বাজারের ছায়া থেকে তার আলো হলই বা শতাব্দী
প্রাচীন। নক্ষত্রের যে আলো দেখা যায় তা-ও কি আজকের।
কি অনিবার্য এই সেলুনের নাম, না? নেপচুন না হয়ে অন্য কোনও গ্রহের নামও হতে
পারত। প্রাণিবহুল জাগতিক এই গ্রহের ভেতরে অন্য গ্রহের অতি ছোট্ট একহারা একাংশ। আমি
তোমাদের মধ্যে থেকেও পুরোপুরি ঠিক এই গ্রহের নই—ঠিক এইখানে এসে মনে হয়, না, নেপচুন
নামটাই ঠিক—এই নামটুকুর সাথে সাধারণ মানুষের জানাজানি থাকলেও, অন্য গ্রহগুলির
ব্যাপারে যেমন তাদের কিছু-না-কিছু একটা অতিরিক্ত জানা আছে, নেপচুনের সাথে তা
নেই—বুধ যেমন সূর্যের সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে গরম—বৃহস্পতি সবচেয়ে বড়—শুক্রকে দেখা
যায় আকাশে, শুকতারা—মঙ্গল অনেকটা পৃথিবীর মতোই, প্রাণ আছে কি নেই, কে জানে—শনির
চারপাশে বলয়—প্লুটো সবচেয়ে দূরে। কিন্তু নেপচুন? তার সম্পর্কে তো কিছুই জানি না।
‘পানিপথে ভ্রমণ’ গল্পের তৃতীয় পৃষ্ঠা চলছে এখন। সেটা শুরু হচ্ছে এভাবে—
১৯০৭ সালে (সিপাহি বিদ্রোহের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হল সে বছর) ব্রিটিশ ভারতের
বোম্বে, মাদ্রাজ প্রভৃতি বন্দর অঞ্চলে এক
অভূতপূর্ব বিদ্রোহ দেখা দেয়। ব্রিটিশ সরকার তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও নাস্তানাবুদ
হয় এই ঐতিহাসিক বিদ্রোহ দমনে।
যদিও পরবর্তীকালে একমাত্র
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া আর কোনও ভারতীয় ইন্টেলিজেন্টের সমর্থন লাভ করতে পারে নাই এই বিদ্রোহ। তার কারণ অবশ্যই এদেশীয় নেতৃবৃন্দের বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী মানসিকতা। কিন্তু
তা সত্ত্বেও এই বিদ্রোহকে ভারতের অন্যতম সর্বাত্মক প্রোলেতারিয়েত বিদ্রোহ বলছেন
মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকগণ। এমনকি এই বিদ্রোহকে অগ্নিযুগের স্বাধীনতা সংগ্রামের
ড্রেস-রিহার্সালও বলা হচ্ছে। কিন্তু যাকে বলা হচ্ছে ড্রেস-রিহার্সাল প্রকৃতপ্রস্তাবে সেদিন তা রীতিমতো স্টেজ-পারফরমেন্সে পরিণত
হয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই বিদ্রোহ ‘ছায়াবিদ্রোহ’ নামে খ্যাত। বন্দর
অঞ্চলের খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষদের সম্মিলিত ছায়াদের
দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল এই বিদ্রোহ। ছায়া—যাকে বলে,
শস্ত্রে ছেঁড়ে না অগ্নি দহে না যারে। ফলে ব্রিটিশ তার কামান গোলা
সব ঢেলেও কাউকে মারতে পারেনি। দিকে দিকে সেদিন প্রকাশ্য রাস্তায় উঠে এসেছিল মেহনতী
মানুষের ছায়া। ঢুকে পড়েছিল জেলখানা, থানা, সরকারি অফিস, বিচারকের বাংলো, আদালত কক্ষ—সর্বত্র। ছায়া
এমনই জিনিস একে জেলে ঢোকানো যায় না। লকাপে বন্দি করা যায় না। চাবুক
মারা যায় না। গুলি করলে গায়ে লাগে না।
টিয়ার গ্যাস এর কিছুই করতে পারে
না। মাথা খারাপ হয়ে গেছিল সেদিন ব্রিটিশের। একমাত্র রবীন্দ্রনাথ সেদিন অনুভব করেছিলেন এই
বিদ্রোহী প্রোলেতারিয়েতের শক্তি। লিখেছিলেন ‘ছায়া
যেন ছায়ার মতো যায়’। সেদিন ছায়ার সাথে তুলনা করা যায় এমন কোনও উপমান তিনি
খুঁজে পান নাই। তাই এক ক’রে
দিয়েছিলেন উপমান আর উপমেয়। এবং লিখেছিলেন এই সর্বহারা প্রোলেতারিয়েতের সংজ্ঞা।
‘ফুলের বাহার নেই কো যাহার, ফসল যাহার ফলল না, অশ্রু যাহার ফেলতে হাসি
পায়
দিনের আলো যার ফুরালো সাঁঝের আলো জ্বলল না, সেই বসেছে ঘাটের কিনারায়’
এমনকি
‘ঘরে যারা যাবার তারা কখন গেছে ঘর পানে’ অর্থাৎ পলায়নশীল এবং ‘পারে যারা যাবার গেছে
পারে’ অর্থাৎ সুবিধাভোগী শ্রেণীকেও সেদিন তিনি চিহ্নিত
করেছিলেন এই লেখায়। এবং নিজের একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন এই ছায়াবিদ্রোহের সাথে। অর্থাৎ,
‘ওরে আয়, আমায় নিয়ে যাবি কে রে
দিন শেষের শেষ খেয়ায়’। কোনও কোনও ঐতিহাসিক মনে করেন তিনি নিজে এই বিদ্রোহে অংশ নিতেও চেয়েছিলেন।
কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন না ‘কেমন করে
চিনব ওরে ওদের মাঝে কোন্ জনা’।
মোটাসোটা এক লোক আসে সেলুনে। দাড়ি কাটতে। ‘সে’ সরে বসে। ওরা কথা বলছে, নিজেরা। গল্পটা পড়ায় মন দেয় ‘সে’, তাই শুরুতেই কথাগুলো টানা কানে আসে না। ছেঁড়া ছেঁড়া হয়ে ঢোকে মোটা
লোকটির গলা।
কোনও নালিপথের
মধ্যবিন্দুতে দক্ষ মিস্ত্রির মতো বসে আছে যে লড়াকু পেশা, তার সাথে উত্তরসূচক
শ্বাসপ্রশ্বাসের মর্যাদা পা ফাঁক ক’রে জমিতে উঠে দাঁড়ায়। শরীরের মাংসপেশীর হঠাৎ
সংকোচনে যে সলোমনজ্ সীল গঠিত হয়, সেনাবাহিনীর মতো নিয়ন্ত্রিত ও পরিকল্পিত গতিতে
হেঁটে না গেলে তা তুমিও দেখতে পাবে। চোয়ানো জল জমে বরফ
হয়ে গেলে যে সরু এবং ছুচলো ঝুলন্ত বরফের কাঠি তৈরি হতে দেখি, ঠিক সেইভাবে ডান
হাতের শাদা হাড়যুক্ত তর্জনীটি লেখক এই গল্পের ম্যানাস্ক্রিপ্টের ওপর রাখে। এবং, রেখে চলে যায়।
—‘আগে একটা রাস্তা জুইড়া করত। এখন দুইটা রাস্তাতেই
প্যান্ডেল।
সারাদিন ধইরা লুক-জন।
বা-ইক।
খিচড়ি। রক্তদান। বৌ-বাচ্চা-ছ্যালেম্যা সবাই মিলা প্যান্ডেলে।’
গালে লাগানো শেভিং ক্রীমের ওপর প্রথম পর্বের ক্ষুর চলছে—ফলে, সেই চলন বুঝে পাংকচুয়েশন
তৈরি ক’রে নিতে হয়, এবং লোকটি অত্যন্ত সার্থক ও সতর্কভাবে তা করেও।
‘বুঝবে বুঝবে।’ আবার
থামতে হয়।
‘একদিন, ঠিকোই বুঝবে।’
ক্ষুর এবারে বাম গালে চলছে। জুলফির নিচ থেকে ঠোঁটের ধার অবধি কাটা হলে
লোকটি আবার বলে, এবং এবারে তার স্কেল পরিবর্তন হয়। খুব সাঙ্গীতিক বোধ ছাড়াই এটা
লক্ষ করা যায় এইবারে লোকটি তার গলায় একটি ক্রোমাটিক নোট লাগালো ফলে স্বর
অবধারিতভাবে অন্য একটি মাত্রায় এসে দাঁড়ায় তথা কাঁপতে থাকে।
‘সরকার যে এই মোসল্লাগুলারে ত্যাল দিয়া দিয়া কি সর্বনাশ করতাসে,
যখন বুঝবে তখন তো আর আমরা থাকুম না।’
ঠিক চিবুক এবং তার নিচের গোল বলটায় ক্ষুর চলায় লোকটির মাথা চেয়ারের
হেড-রেস্টে এসে পড়ে এবং উচ্চারণেও অস্পষ্টতা আসে, যেহেতু চোয়াল ও ঠোঁট পুরোপুরি
খোলা যাচ্ছে না।
‘তবে বুঝবে, য্যাদিন অদের মা-বইনরে ধইর্রা টানবে।’
এবারে কিছুটা সময় পাওয়া যায়। যেহেতু প্রথম পর্বের ক্ষুর চালনা শেষ। দ্বিতীয়
পর্বের শুরুর আগে ব্লেডটাকে খুলে আবার লাগানো হচ্ছে। বলা বাহুল্য তার আগে বাঁ-হাতের
ক্রীমগুলো একটি প্লাস্টিকের ছোট গ্লাসে চেঁছে রাখা হল এবং শেভিং ব্রাশের অবশিষ্ট
ক্রিম আবার তার গালে লাগানো হচ্ছে। এই এতটা সময় পেলে যেকোনও সময়-সচেতন মানুষ যা
করে থাকেন ইনিও তাই করলেন। এইটুকু সময়পর্বের মধ্যেই যে মূল কথার পরিশিষ্টাংশ তাকে সেরে
ফেলতে ফেলতে হবে তা তিনি শুরুতেই বুঝে নিয়েছেন এবং অপেক্ষা করছিলেন ঠিক এই
গ্যাপটুকুর জন্যেই। লক্ষ করা যেতে পারে, ঠিক এই জায়গায় তার গলার স্বরও কিছুটা নিচু
হয়ে আসে এবং লয় একটু দ্রুত হয়। যার চলন বেশ একটু এঁকে-বেঁকে।
‘মসজিদে তো আগে পাঁচিলই ছিল না। অখন আটফুট পাঁচিল দিয়া দিসে।’
দ্বিতীয় বাক্যের দ্বিতীয় শব্দে (‘আট ফুট’) তিনি যে ভ্রূ-উত্তোলন করলেন তা
না-দেখেই বলে দেওয়া যায়।
‘ভিতরে যে কী করে কে জানে। আগে
তো আমরা ছুটবেলায়
অইখানে
দেখসি বাঁশঝাড়। ডাবগাছ। অখন তো চিনাই যায় না। এলাহি ব্যাপার। বললে
বলে, তোমরা যে প্যান্ডেল কইরা দুর্গাপূজা করো। ...অ,
ভালো কথা, আইজকে ভোরে ভূমিকম্প হইসিল, ট্যার পাইসিলেন?
দূরত্ব কত রকমের হয়। গতিই না কত প্রকার। এক তো
বস্তুগত দূরত্ব, বস্তুগত গতি। কলকাতা থেকে ভূবনেশ্বরের দূরত্ব—এবং সেই দূরত্ব
অতিক্রম করার গতি—আরেক হয়, নিজের চিন্তাকে এক জায়গা থেকে তুলে বা টেনে আরেক জায়গায়
নিয়ে আসা, তার দূরত্ব এবং এই ‘নিয়ে আসা’র গতি। ভাবগত দূরত্ব। ঠিক যে গল্পটা, ন্না
গল্প নয়—যে ঘটনা, নির্মিত যে ঘটনাটা এই উপন্যাসে আমরা কয়েকজন মিলে বলতে চলেছি,
সেটা এত ঘুরপথে একটা কল্পিত কাহিনির মতো মোড়ক দিয়ে না-ও বলা যেত, যেতই; একদম আস্ত
মুড়োর মতো সোজা রেখে দেওয়া যেত থালায়—কিন্তু যেহেতু আমরা একে-অপরকে এখনও যথেষ্ট
মাত্রায় জানি না, চিনি না—আবার নিজেদেরকেও নিজেরা খুব সামান্যই জানি, অন্যের কাছে
সম্পূর্ণ দিয়েও দিতে পারি না, এখনও—যেহেতু এরকম অবস্থা এখনও রয়েছে, সারা পৃথিবীর
যেকোনও সমাজব্যবস্থার মধ্যেই রয়েছে, তাই এই ঘুরপথেই আমাদের যেতে হবে
নৈর্ব্যক্তিকতা ও অনিবারণীয় আত্মমগ্নতার দিকে। তবে, ঘুরপথে আমাদের এই ঘটনাক্রমে বা
প্রবাহে যে ভাব বা আত্মগত দূরত্ব বাড়ছে, বলা বাহুল্য। আসলে, একটা একবগ্গা
গণ্ডারের মতো শিং উঁচিয়ে পূর্বনির্দিষ্ট ভাবনাপথ ধ’রে সোজা ও একমুখী এগোলে আসল
সমস্যাটার গোড়ায় আর কিছুতেই পৌঁছানো যাচ্ছে না। যত কিছু ভাবার বা বলার বা লেখার
ছিল, আমি ভাবছি তার সবই আমি ভেবেছি/বলেছি/লিখেছি। তুমিও তাই-ই ভাবছ যে তুমি সবটা
ভেবেছ/.../...। কিন্তু আমাদের সব কথা ছাড়িয়ে প্রতিবারই দেখা যাচ্ছে সমস্যা আরও
অনেকটা দূরে এগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ধরতে তাই সোজা একমুখে এগোলে আর হচ্ছে না। বরং
তার এবং আমাদের অবস্থান বুঝে প্রতিনিয়তই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চলার ছক পালটে নিতে
হচ্ছে। মাঝরাতে পুলিশ যেভাবে একটা বাড়ির চারদিক ঘিরে সেখানে রেড করতে ঝাঁপায়,
অক্টোপাসের মতো বহুদাঁড় বিশিষ্ট সে ঘিরে ফেলা—এক-একটা চলন্ত শুঁড় আমারই প্রতিনিধি
হয়ে বিভিন্ন দিক থেকে সমস্যাকে ঘিরছে।
—‘শুনলাম হইসিল। আমি ট্যার পাই নাই’
—‘মণিপুরে এপিসেন্টার। ইম্ফলে। পুরা তো টেররিস্টের
জায়গা। বেশি কইরা অইদিকে ভূমিকম্প হওয়া দরকার।’
পুরনো চশমার
পাওয়ারে ফেলে আসা দৃষ্টি। জামায় লেগে থাকা হলুদ দাগের
মতো তার কাচে লেগে থাকা দৃশ্য। তারা কি এখনও কথা
বলে সেদিন কী দেখেছিল। দেখেছিল যেন জল
অন্তঃসত্ত্বা। তাই তার পেট।
তাই
তার ঢেউ।
পড়া শেষ ক’রে ‘সে’
উঠে পড়ে। সন্ধে হয়ে গেছে। শীত শীত। নাকি শীতের কল্পনা?
সরকারি দলের পথসভা হচ্ছে বাঘাযতীন মোড়ে। কি বিরক্তিকর ন্যুব্জ এই দিনগুলো। মাটি থেকে অত্যন্ত কম উচ্চতায় মেঘ এই শহরে এমনভাবে ঢেকে থাকছে, ঠিক শুয়োরের
মাংসের ওপর যে শক্ত স্তর। এক-একটা শব্দ স্টোনম্যানের
মতো কয়েক হাজার হাওড়া স্টেশনের হৈ হৈ ছুঁড়ছে মগজে। বিলুপ্তপ্রায় এক
প্রজাতির মতো ধুঁকে-ধুঁকে চলা কয়েকটা জলাধার এবং তার পাশের
ঘাস থেকে এখনও যেটুকু আলো, তাপ এবং শব্দ প্রতিফলিত হয় তা আলোকরশ্মির গতিপথের
সরলরেখা থেকে বিচ্যুত হয়েছে, কবেই। দর্শনের মূল্যে কোনও রাজনৈতিক কাঠামো নেই।
রাজনীতির মূল্যে কোনো দার্শনিক কাঠামো নেই। পায়ের নিচ থেকে কাগজ-কাটা যন্ত্র কুচকুচ
ক’রে স্লাইস করছে পায়ের চেটো, গোড়ালি—মানুষ তাও পা সরিয়ে নেয় না। কই, নিচ্ছে না তো। নিজের
রক্ত নিজেই দেখছে, দেখছে পাশে দাঁড়ানো লোকটারও পা কাটছে মেশিন—কি নিখুঁত মাপ—টম্যাটো
সস্ ছেটানো পাতলা পাতলা শসার স্লাইস—এটাকেই রাজনৈতিক সমর্থন বা আনুগত্য ভাবছে
দলগুলো। অথবা এভাবেও ভাবা যায়, যখন তার ক্রিয়া আছে কিন্তু
লক্ষাভিমুখী ক্রিয়া নেই তখন স্লাইস মেশিনকে করোটির শেষপ্রান্ত অবধি উঠে আসতে বাধা সে
দেবে কেন। তাই সিপিএম, তৃণমূল বা বিজেপি কাউকেই সে নির্বাচন করেনি। প্রকৃতপ্রস্তাবে
মানুষ সরে না দাঁড়ানোকে নির্বাচন করেছে। বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা
তার থাকবেই। ক্রীতদাস যদি নিজেকে শৃঙ্খলমুক্ত করার একটুও চেষ্টা না
করে, তবুও সে স্বাধীন—শৃঙ্খল সে বেছে নিয়েছে। ইকোনমিক্সে লেমন থিওরি ব’লে একটা থিওরি
আছে। খুব সোজা। এবং দুঃখের। বাজারে গিয়ে আলু কেনার সময় আমরা বুঝতে পারি না এটা পচা হবে
কিনা। নেড়েচেড়ে বা টিপে দেখি বটে, কিন্তু আলুটা সত্যিই কেমন সেটা জানার জন্য বাড়িতে এনে কেটে দেখা অবধি অপেক্ষা করতে হয়। একবার
কেটে ফেললে দোকানে আর ফেরতও চলে না। কে জানতো, শতাব্দীর শেষ জুয়াও
একটা পচা আলু হবে। অন্তিমে, উল্লেখ থাকে, ইকোনমিক্সে লেমন থিওরি ব’লে একটা থিওরি
আছে। খুব সোজা। এবং দুঃখের।
বিজ্ঞাপনের বিরাট
লোহার ফ্রেমে লাগানো মস্ত ব্যানারটা খুলে গেছে। শুধু ওপরের দিকে লোহার ফ্রেমের
সাথে সেঁটে আছে কিছুটা। আর হাওয়া দিচ্ছে সাঁই সাঁই ক’রে তখন। লোহার কালো দাঁত বের করা ফ্রেমটাকে ন্যাংটো রেখেই তাই ফড় ফড়
ক’রে
উড়ছে ফ্লেক্সটা। ফ্লেক্সের ওপরের দিকে কিছুটা ফ্রেমের সাথে লেগে থাকায় পেছনেও ঘাপ
ঘোপ টান পড়ছে তার। আর সামনেও হাওয়া টানছে। যেখানে ইতিমধ্যে—
‘১৬ই অগাস্ট ঘোষণা হল সীমান্ত রোয়েদাদ। ‘পঞ্জাব বাউন্ডারি ফোর্স’ ভেঙে
দেওয়া হল ২রা সেপ্টেম্বর। পশ্চিম পঞ্জাব থেকে সাফ ক’রে দেওয়া হচ্ছিল হিন্দু আর
শিখদের। পূর্ব পঞ্জাব থেকে সাফ করা হচ্ছিল মুসলমান।
একদিন শেষ বিকেলে ফিরোজপুর স্টেশনে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ঢুকল উদ্বাস্তুদের
জন্য সংরক্ষিত একখানা বিশেষ গাড়ি। তার চালক আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। গার্ড মৃত
অবস্থায় পড়ে আছেন নিজের কামরায়। স্টোকারের কোনও পাত্তা নেই। আমি প্ল্যাটফর্ম ধরে
হাঁটতে লাগলাম। দেখলাম দু’খানা বাদে আর সব বগি রক্তে মাখামাখি। তৃতীয় শ্রেণির
একখানা কামরায় তিনটে মৃতদেহ রক্তে ভাসছে। লাহোর আর ফিরোজপুরের মাঝখানে কোথাও গাড়িখানাকে
থামিয়ে দিনের আলোয় সবার সামনে এই নিখুঁত কসাইগিরি সেরেছে সশস্ত্র মুসলিম জনতা।
আরও একটা দৃশ্য আমি সহজে ভুলব বলে মনে হয় না। পাঁচ মাইল লম্বা এক মুসলমান
উদ্বাস্তু মিছিল শামুকের গতিতে সরযূ নদীর সেতু পার হয়ে ঢুকছে পাকিস্তানে। গোরুর
গাড়ির ওপর তাগাড় করা রয়েছে হতদরিদ্রের পুঁটলিপাঁটলা, হাঁড়িকুড়ি। পাশে পাশে চলেছে
গোরু, মোষ। কোলে বাচ্চা আর মাথায় ভাঙাচোরা টিনের বাক্স নিয়ে মেয়েরা চলেছে। কুড়ি
হাজার নারী, পুরুষ আর শিশু ধুঁকতে ধুঁকতে চলেছে তাদের অভীষ্ট ভূমির উদ্দেশে—এজন্যে
নয় যে ওই ভূমি সত্যিই তাদের অভীষ্ট, বরং এই জন্যে যে ফরিদকোট রাজ্য আর ফিরোজপুর
জেলার অভ্যন্তরে হিন্দু আর শিখদের দলবল শয়ে শয়ে মুসলমানদের কুপিয়ে কুপিয়ে
মেরেছে...’
Life
in the Punjab today, Swatantra (A Madras based weekly magazine), 4 October,
1947
কৃষ্ণা
গ্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছিলাম দূর আকাশ থেকে উলটো হয়ে পড়তে থাকা এক
মানুষ—ফেরত আসা রকেটের মতো ভীষণ জোরে, নামছে তো নামছেই—একসময় রেলের পোস্টে বা
মোবাইল টাওয়ারে তার মাথা ধাক্কা খায় ও ফেটে যায়—ও হো হো হো—উল্লাস করে উঠি
সবাই—হুই হুই সিটি—সমষ্টির দিকে ধেয়ে আসা একটা রকেট বা আত্মঘাতী বোমা যেন—আকাশে ফেটে
যাওয়া আতসবাজির বারুদটুকরো যেভাবে ছড়িয়ে-ছড়িয়ে নামে, মাথা ফেটে ঘিলু ও করোটির টুকরো-অবশেষ সেইভাবে
আমাদের দিকে পড়ছে—কিছু আমাদের থেকেও দূরে—কোনও বাড়ির ছাদে—কোনও বস্তির পেছনে—দেখে
মনে হয়, নিউট্রাল গীয়ারে নামছে—আমরা
পাশাপাশি ও ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকলেও আমাদের দু’টো দেহের মাঝখানে থাকা দুর্লঙ্ঘ
শূন্যতা একটিকে অপরটি থেকে শুধু বিচ্ছিন্নই রাখে না, আমরা উভয়েই সে শূন্যতা
প্রত্যক্ষও করি—ক’রে যাই—কেননা আমাদের তা ক’রে যেতে হয়, তাই;--আমাদের একে-অপরের
চামড়ায় ঘষা লাগলেও তা থেকে আর কোনও তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ ঢেউ তোলে না মগজে—কেননা,
আমাদের ঘিলু, ওই যে ওই উঁচু থেকে ফেটে ছড়িয়ে নিচে নামছে, আমাদেরই দিকে—এসবই আমরা
দেখছিলাম, দেখছিলাম দূরে দাঁড়িয়ে—পেছনে ওই ওদিকে গঙ্গা তার কোমর বেঁকিয়ে ঘুরছে তো
ঘুরছেই—ঘুরেই চলেছে—সেখানেও পড়বে কিছু, ঘিলুর অবেশেষ, করোটির ভাঙা শিং—এখানে
গঙ্গার কোনও বুক নেই—বুক নেই তাই বোঁটা নেই—বোঁটা নেই তাই দুধ নেই—দুধ নেই তাই
শিশু নেই—তারও আগে একটা বাস স্ট্যান্ড—সেখানে বাস ধরবে ব’লে মাঝরাত থেকে লাইনে
দাঁড়ানো মানুষের কিউ—যাকে সার্ত্র আরও পরে সমষ্টি বা গোষ্ঠী বলবেন না, বলা যায় না
তাই বলবেন না, বলবেন কালেক্টিভ—এবং এও বলবেন যে, কিউ-এর সারিবদ্ধ এই মানুষ নিঃসঙ্গতার
বহুত্বেরই নামান্তর—ও হো হো হো—সার্ত্র এ কথা বলার আগেই লাইন দাঁড়িয়ে গেছে—এবং
ক্রমশ তা দীর্ঘতর হচ্ছে—মাঝরাতের ঘুম ঠেলে দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসছে—এত রাত, তাই
গাড়ি-ঘোড়া কিছু নেই, হেঁটেই তো আসছে—আর এসে দাঁড়িয়ে পড়ছে লাইনে—পাশাপাশি দাঁড়িয়ে
থাকলেও যাদের কোনও ঐক্য বোধ নেই, ছিল না, থাকবে না—এখানে বিচার হবে সংখ্যা দিয়ে—এই
সারিবদ্ধ মানুষের সিরিয়াল এক্জিসটেন্স নিঃসঙ্গ এবং শক্তিহীন—আরও বললে, এর কোনও
মুখ নেই, ইহা যান্ত্রিক এবং স্থূল—আমাদের এই নগরে গোটা শহর এভাবেই বেঁচে আছে—আকাশে
ফেটে যাওয়া আতসবাজির ঘিলু উল্কাগতিতে কিভাবে নেমে আসছে বিস্ময়ে তা দেখতে দেখতে—সরে
যাওয়ার কথা ভুলে—হুই হুই সিটি দিতে দিতে এবং বাসের জন্য লাইনে দাঁড়ানো কিউ-এর মতো। হাতে তালি দিতে দিতে আমরা পরস্পরের
দিকে তাকিয়ে দেখি আমাদের প্রত্যেকের হাত কনুইয়ের নিচ থেকে কাটা। এছাড়া আমাদের কোনও
স্মৃতি নেই। ইতিহাস নেই। অতীত নেই। ঐতিহ্য নেই। সারিবদ্ধ লাইন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা
ছাড়া বর্তমান নেই। সকাল হলে দেখা যাবে, সারারাত আমরা যারা বাসের জন্য লাইন দিয়ে
দাঁড়িয়েছিলাম, প্রকৃতপক্ষে এটা বাস স্ট্যান্ডই নয়, এটা, পরিত্যক্ত একটা কবরখানায়
ঢোকার মুখ। একটা
নীল-শাদা ত্রিফলা দাঁড়িয়ে আমাদের পাশে। অর্ধ-উড়ন্ত একটা দাঁড়কাক মনোস্থির করতে
পারে না সে ত্রিফলার কোন্ দণ্ডে বসবে।
ওদিকে
আরও কয়েক লক্ষ লোক—
‘রোদ, বৃষ্টি আর পঞ্জাবের সেই কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে দিয়ে চলেছে। ভারতের
সমভূমিতে নিচু হয়ে উড়ছে তাদের যাত্রাপথের ধুলো। মিশে যাচ্ছে ভয় আর ঘাম, মলমূত্র আর
গলিত শবের গন্ধের সঙ্গে। ঘৃণার ধুলো যখন থিতিয়ে এল, তখন নাম ডেকে ডেকে হিসেব
মেলানো আরম্ভ হল, কতজন মরেছে তার হিসেব। স্তম্ভিত দেশ জুড়ে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হল
দশ লক্ষ মানুষের নাম—যারা মরেছে গুলি খেয়ে, তলোয়ারের কোপে, ছোরার আঘাতে, ছুরির
ঘায়ে আর মহামারীতে। ...তা ছাড়াও ছিল সেইসব ক্লান্ত, নম্র হৃদয়ের মানুষ যারা তাদের
লুন্ঠিত উদ্যানগুলোর দিকে চেয়ে থেকে থেকে অবশেষে লুটিয়ে পড়ে মরে গেছে। কী লাভ
বেঁচে থেকে, যদি মানুষের মন থেকে বোধবুদ্ধি লুপ্ত হয়ে যায়, যদি মানুষ এমন উন্মত্ত
হয়ে দাপাদাপি করে? কী হবে ত্রিশূলের ডগা থেকে তোমার শিশুকে বার করে এনে? কী হবে
কূপের তলার কাদামাটি থেকে তোমার প্রিয়াকে তুলে এনে?’
Donald F. Ebright,
Free India; the First Five Years; An Account of the 1947 Riots, Refugees,
Relief and Rehabilitation (Nashville: Parthenon Press, 1954), p. 28
গত কয়েকদিনের খবরের
কাগজের বিভিন্ন শিরোনামগুলো দেখা যাক। বলা বাহুল্য, এগুলো বেশিরভাগই ‘উত্তেজনাপ্রবণ
সাংবাদিক আর নিরাশাপ্রবণ পেশাজীবীদের’ লেখা।
‘১৯৯৫ থেকে এখনও অবধি ভারতে
কৃষক আত্মহত্যা তিন লক্ষ ছাড়াল’
‘বিচ্ছিন্নতার প্রচেষ্টায়
প্রথম সারিতে জেনইউ, যাদবপুর’
‘অনন্তনাগে সৈন্য মোতায়েন,
কারফিউ’
‘তামিলনাড়ুতে মিছিলের ওপর
গুলি, মৃত ৩’
‘অযোধ্যা
আন্দোলনকে দেখতে হবে সাংস্কৃতিক সচেতনতা ও উপলব্ধির এক সূচনাবিন্দু হিসেবে : অরুণ শৌরী’
‘দিল্লিতে আজাদি মিছিলে কুড়ি
হাজার ছাত্র’
‘রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড ত্যাগে
ক্ষুব্ধ দেশের সরকার’
‘নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে খতম
১৭ মাওবাদী’
‘অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্রের
স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে : ঠাকরে’
‘দক্ষিণ
ওড়িশায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ’
‘গুলিবিদ্ধ
মহাত্মা’
‘অর্থনীতির
ভোলবদল : বাজার খোলা হল’
‘জেনইউ-এর ছাত্রগোষ্ঠী অনশনে’
‘নন্দীগ্রামে ভয়াবহ পুলিশী সন্ত্রাস’
‘জঙ্গীদের
হাতে ভারতীয় মসজিদের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে সমাধিস্থ হল সম্প্রীতির সব আশা : লন্ডন টাইমস’
‘আমলাশোলে
অনাহারে মৃত্যু, অস্বীকার বামেদের’
‘মণিপুরে
মেয়েদের নগ্ন মিছিল’
‘সারা দেশে জারি হল জরুরি অবস্থা’
‘সোভিয়েত
ভেঙে গেল’
‘আবার
বন্ধ চা বাগান’
‘উড়িষ্যার কাশীপুরে বক্সাইট প্রকল্প, বিদ্রোহে
আদিবাসীরা’
‘স্বাগত
নতুন : স্বাধীন বাংলাদেশ’
‘ঔরঙ্গাবাদে
বর্ণহিন্দুরা তপশিলি জাতির মহল্লায় ভেঙে দিল বুদ্ধমূর্তি’
‘বদলা
নেওয়া আমাদের ধর্মীয় কর্তব্য : লস্কর প্রধান’
‘আলাদা
রাজ্যের দাবি থেকে সরছি না : ঘিসিং’
‘কাশ্মীরে
পণ্ডিতদের নৃশংসভাবে হত্যা হিজব-উল-মুজাহিদিনের’
‘কিষেণজি
নিহত’
‘তেলেঙ্গানায়
কৃষক অভ্যুত্থান’
‘স্বাধীনতা
চাইছে নাগাল্যান্ড’
‘বিশ্বকাপ
ফাইনালে আজ কপিলের টিম’
‘গুজরাত দাঙ্গায় মৃত বেড়ে দু’
হাজার’
‘নকশালবাড়ি
আন্দোলন ব্যর্থ হবে না : কানু সান্যাল’
‘এক
ধাক্কা অউর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো : সাধ্বী ঋতম্ভরা’
‘উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন
জারি থাকবে, জানাল দিল্লি’
‘হরিয়ানার
ঝাঝার গ্রামে ৬ জন দলিতকে পুলিশের সামনেই পিটিয়ে মারল জনতা’
‘দিল্লিতে
শিখ নিধনের যুক্তি দিলেন রাজীব : বনস্পতির পতন হলে ধরণী
তো কাঁপবেই’
‘সন্ত্রাসবাদী সূর্য সেনের
ফাঁসী’
‘হিরোশিমার ঘটনায় জাপানবাসীর
কাছে ক্ষমা চাইতে রাজি নন ওবামা’
‘আদিবাসী বিদ্রোহে উত্তাল
বস্তার : পুলিশের গুলিতে নিহত ৩৯’
‘হিন্দি
চাপানোর বিরুদ্ধে তামিলনাড়ুতে রাজ্যব্যাপী প্রতিবাদ’
‘ওড়িশায় এক মিশনারিকে দুই পুত্র সহ জ্যান্ত পোড়াল বজরং’
কোলকাতার বদলা নিল নোয়াখালি,
নোয়াখালির বদলা নিল লাহোর, লাহোরের বদলা নিল বিহার, বিহারের বদলা নিল
গড়মুক্তেশ্বর, গড়মুক্তেশ্বরের বদলা নিল মথুরা, মথুরার বদলা নিল বারাণসী, বারাণসীর
বদলা নিল ধর, ধরের বদলা নিল বুদান পাহাড়, বুদান পাহাড়ের বদলা নিল গুজরাত, গুজরাতের
বদলা নিল মধ্যপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের বদলা নিল অসম, অসমের বদলা নিল উত্তর প্রদেশ,
উত্তর প্রদেশের বদলা নিল কর্ণাটক, কর্ণাটকের বদলা নিল বোম্বাই, বোম্বাইয়ের বদলা
নিল কাশ্মীর, কাশ্মীরের বদলা নিল পঞ্জাব, পঞ্জাবের বদলা নিল দিল্লি, দিল্লির বদলা
নিল ইন্দোর, ইন্দোরের বদলা নিল বোকারো, বোকারোর বদলা নিল বেলচি, বেলচির বদলা নিল
ছোটনাগপুর, ছোটনাগপুরের বদলা নিল গুয়া...
ত্রিশূলের বদলা নিল ছোরা,
ছোরার বদলা নিল তরোয়াল, তরোয়ালের বদলা নিল বন্দুক, বন্দুকের বদলা নিল পেট্রোল
বোমা, বোমার বদলা নিল গ্যাস সিলিন্ডার...
আমার ফুসফুসকে আমি
বিশ্বাস করি। কিন্তু এখনও তাকে ভালো ক’রে চিনি না। আমার লিভার এবং কিডনী সম্পর্কেও
একই কথা। আমার ডান হাতটিকে আমি কতটা ভালোবাসি কিংবা বাঁ পায়ের অনামিকাটিকে,
স্বাভাবিক দৈনন্দিন অবস্থায় এ ঠিক বোধগম্য নয়। এমন কিছু দীর্ঘ-লালিত
ব্যক্তি-অভ্যেস আমি আমার সাথে নিয়ে চলেছি যেগুলো সঙ্গে না রাখলে আমি অনেক সাধারণ
চিন্তা-ভাবনাই করতে পারতাম না।
বেশ ছোটবেলায় একবার, নদে জেলার সেই একচিলতে গ্রামে,
মাঘ মাসের কাক-না-ডাকা ভোরে, মা ডেকে তুললেন আমায়—আলো তো তখনও ফোটেনি—আমি ঘুমের
সাথে আমার জাগরণের একটা মোটামুটি বন্ধুত্ব বা আপোস করিয়ে দিতে দিতে চোখ পিটপিট
করছি—আর কখন নিজেই এসে পড়েছি ঘরের বাইরে, উঠোনে—হ্যাঁ, খালি পায়ে, এবং পায়ের পাতা
ও শরীরের প্রত্যেকটি আচ্ছাদিত ও উন্মুক্ত রোমকূপ দিয়ে প্রবেশরত শৈত্য আমাকে জানায়
যে, সে আমারই অপেক্ষায় ছিল—তখনই মা আমার হাতে ধরিয়ে দেন মাটির একটি মালসা—যাতে
ধূসর বর্ণের টলটলে এক তরল—আমি দু’হাতের করতলে তা ধরি—মুখের কাছে নিয়ে আসি—আমার ঘাড়
থেকে মাথাও তখন আনুমানিক পঁচাশি ডিগ্রি কোণে মালসার দিকে হেলেছে—চোখ ও তার দৃষ্টি
আনুভূমিক থেকে সরে পুরোটা উল্লম্ব না হলেও কিছুটা তেরছা এসে পড়েইছে মালসার
দিকে—তখনই অন্ধকার আরও একটু আবছা হ’ল—বস্তুত ভোরের সময় যেরকমটা হয়—প্রতি মুহূর্তেই
একটা-একটা ক’রে অন্ধকারের টোন সরে যেতে থাকে—এবং আলোর একটা ক’রে পোঁচ পড়তে থাকে
চারপাশের গায়ে—তখন, দু’হাত দিয়ে মাটির মালসাটিকে মুখের কাছে এনে আমি দেখতে পাই—আরও
স্পষ্ট এবং অব্যর্থভাবে বললে আমি দেখে ফেলি—মালসায় ওই ধূসর বর্ণীয় তরলে একটি মুখের
আভা—ওই একই সময়ে আমার দু’ঠোট তখন ফাঁক হয়েছে—এবং তার মাঝখানে মালসার একটি কাঁধ
অবস্থান নিয়েছে, আমার জিভ ও মুখে এসে পড়েছে সেই তরলের প্রথমাংশ—উত্তর
প্রথমাংশ—প্রাক্ দ্বিতীয়াংশ—এইভাবে ক্রমে আরও—যুগপৎ একইসাথে মালসায় ওই ধূসর
বর্ণীয় তরলে ততক্ষণে আমি দেখে ফেলেছি এবং দেখছি একটি মুখের আভা—অবধারিতভাবে সে মুখ
আমার শৈশব। মালসায় প্রকৃত পানীয়, খেজুর রস। এখানে প্রধান এবং তীক্ষ্ণতম বিন্দুটি
হল, ওই মুখের আভা। কিন্তু সমস্যা হ’ল, বিন্দু-বিন্দু শীতের সামগ্রিকতা এবং আমার
জিভ ও মুখে আসা খেজুর রস—যা আমার অন্তঃস্থ প্রতিটি নালিপথকে সেই মুহূর্তে আদিম ও
বনজ ক’রে তুলেছিল—ঠিক এরকম ভোর-মুহূর্তে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এবং অবশ্যই একটি মাঠ বা
চর পেরিয়ে নদীতীরে দাঁড়ানো হরিণ যেভাবে মুখ নিচু ক’রে জলে জিভ দেয়, চাটে—একইসময়ে জলে
সে দেখতে পায় নিজেরই মুখ—যার ফলে শৈশবের ওই ঘটনাটিকে আমার জীবনের একটি আদিম
বন্যমুহূর্তের স্মৃতি বলেই মনে হয়—আমি স্পষ্টই দেখতে পাই, রসপান রত ওই মুহূর্তে
আমার দু’ কানের পাতা কিরকম সোজা খাড়া হয়ে দাঁড়ায় এবং একটু চুমুক দিয়ে আমি পুনরায়
মুখ তুলে সামনেটা ও চারপাশ দেখি—আবার তরলে ঠোঁট দিই—ঠাণ্ডায় আমার রোমকূপগুলো আরও
স্পষ্ট হয়ে হরিণের চামড়ার মতোই বুটি-বুটি দানাদার হয়ে উঠেছে—আমার চামড়াও শীতে অল্প
চিরিক-চিরিক কাঁপছে—সেই বন্যতা আরও স্পষ্ট বোঝা যাবে যদি তখন আমার পা দু’টো দেখা
যেত—পায়ের আঙুলগুলো মাটিতে রেখে, পাতার মাঝখান থেকে গোড়ালি অবধি আমি তখন উঁচু ক’রে
রেখেছি এবং মাঝে মাঝে খুব ধীরে অল্প ঘসঘস ক’রে পায়ের পাতা ঘষছি—লেজ সোজা ক’রে গুলবাঘ
যেভাবে লাফানোর আগে পেছনের পা দু’টো ঘষে। শীতের হিম প’ড়ে থাকা সারারাতের ভেজা উঠোন
আমার পায়ের আঙুলের ছাপ নিশ্চয়ই খুব ভালোভাবে নিয়ে রেখেছিল সেদিন। প্রকৃতপ্রস্তাবে
আমি তখন সেই মানবজন্তু যে-তার উৎস-মুহূর্তেই এমন কিছু দীপ্তি ও অভিলাস টের পেয়েছিল
যা আদিম এবং বন্য। এতটা লেখার পর যদি বলি, আমি দেখতে পাচ্ছি বাড়ির উঠোনে
মাটির মালসা হাতে খেজুর রস পানরত সেই শিশু অথবা নদীতীরে ভোরের জলপানরত হরিণ—কেউই নেই—যা
রয়েছে, তা আমি—এই গোটা আমি; মূর্ত-জগৎস্থিত মূর্ত-আত্মসচেতন আমির স্ব-হেতু-সত্তা—এই
অনুচ্ছেদের ঠিক শেষ-লাইনের পরে ডান দিকের কোণে সে জানু পেতে বসেছে—দু’ হাত
কৃতাঞ্জলির মতো জড়ো হয়ে মুখের কাছে আনা—যেন চরণামৃত পান করছে, এইভাবে—আর, শব্দ আর
লাইনের ফাঁকে শাদা অঞ্চল দিয়ে এঁকেবেঁকে নেমে আসছে সেই খেজুর রস, যেভাবে বহুধারায়
ভেঙে ঝরনা প্রস্রবিত হয় পাহাড়ের পিঠে—তাহলে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না।
খেজুর রসের চরণামৃত
খেতে-খেতে আমি শুনতে পাই বৃষ্টি নেমেছে। অথবা কে জানে হয়ত খেজুর রসই নেমেছে বৃষ্টি
হয়ে। রাস্তায় কোমরের কাছাকাছি জমে থাকা রস ভেঙে হেঁটে যাচ্ছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
চোখে তার ঘর ছাড়া বিবাগীর দৃষ্টি। জিহ্বায় পাগলের কবিতা।
‘কুশাসনে বসতে আমার ভালো লাগে না
ভালো লাগে না আমার ইন্দ্রজাল—মোহরের
গল্প
আলিবাবা ভালো লাগে না আমার
ভালো লাগে না আমার সাধারণতন্ত্র—দেহ
বিক্রি
আমেরিকার কোনো কিছু ভালো লাগে না আমার—
কেনেডির মৃত্যুই আমার ভালো লেগেছিল।’
আমার অস্তিত্বের ভেতর বিরাট এক শূন্যতার মতো
কুণ্ডলী পাকিয়ে ব’সে আছে এক কৃমি। ‘আমি’ এই শূন্যতার উৎস নয়, শূন্যতাই আমার সবরকম
অস্তিত্বের এবং অস্তিত্বগুলির মধ্যে সম্পর্ক ও দ্বন্দ্বের ভিত্তি। সার্ত্র-এর ‘লা নোজে’ উপন্যাসের আঁতোয়ান রকাঁত্যাঁ-র মতো আমার আমির পেছনে
লাগাতার লাথ মারছি আমিই। আমার নির্বাচনের বাধ্যতা আর স্বাধীনতাবোধ হল সেই পা যা
আমির পেছনে বীভৎস উপগ্রহ চিত্রের মতো লাথ হয়ে উঠেছে।
(চলবে)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment