Wednesday, July 6, 2016
নতুনের চোখে
“সাধারন পাঠক কি নেবে তা আমি ভাবিনা।পাঠক তৈরী করাই আমার
ভাল লাগে।আমি সাধারন পাঠক চাইনা।ভাল পাঠক সচেতন পাঠক আমি চাই।“(সজল
বন্দ্যোপাধ্যায়)
কবির এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলি, আমি সদ্য লিখতে আসা একজন
কবিতা লেখক ও পাঠক।জলপাইগুড়ির শ্যামলছায়ার আড্ডায় সজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা শুনে
তাঁর লেখার প্রতি আগ্রহী হই।
ছয়ের দশকে বাংলা কবিতায় দুটি গুরুত্বপূর্ন আন্দোলন হয়েছিল। ‘শ্রুতি’ এবং
‘হাংরি’। এদুটির মধ্যে অবশ্যই বাঁক বদলের
একটা ইঙ্গিত ছিল।যার জন্য পরবর্তী প্রজন্ম এঁদের মনে রাখে।শ্রুতি কবিতা আন্দোলনে
যেসব কবিরা যুক্ত ছিলেন তাঁদের অন্যতম ছিলেন সদ্যপ্রয়াত কবি সজল বন্দ্যোপাধ্যায়।এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত কবিরা বিশ্বাস করতেন,কবিতা লিখে
নিছক প্রথানুগ পথে চলার চেয়েনতুন পথের সন্ধান করতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়াও কাম্য।
কবির জন্ম,৮ই মে (পঁচিশে বৈশাখ) ১৯৪২ সালে। কলকাতায় বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বি.এ
(অনার্স সহ) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ করেছেন।নেশায় কবি পেশায়
শিক্ষক ছিলেন।একটানা একত্রিশ বছর শিক্ষকতা করেছেন সেন্টজেভিয়ার্স স্কুলে।কবিতায়
কৃতিত্বের জন্য পেয়েছেন ‘Bridge in making’ পুরস্কার,মহাদিগন্ত
পুরস্কার,কৌস্তুভ পুরস্কার।কবিতায় যাত্রা শুরু ‘তৃষ্ণা আমার তরী’ থেকে ৯টি
কাব্যগ্রন্থ ‘কথাবিন্দু’ অবধি।
কবির চেহারার আভিজাত্য তার সাথে মানানসই ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আরমুখে লাগানো পাইপ
তাকে আকর্ষনীয় করেছিল। তাঁর মত পাইপের সংগ্রহ কলকাতায় কম লোকেরই ছিল।এ প্রসঙ্গে
একসময় তিনি ‘এখন বাংলা কবিতার কাগজে’ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সময় নষ্ট,জায়গা
নষ্ট,ফুসফুস নষ্ট’।তাঁর গলায় টপ্পা বা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে
শুনতে বিভোর হয়ে যেতেন সকলে।এই অভিজাত কবি ও গায়ক যিনি ছিলেন কিনা মুকুটহীন সম্রাট
তাঁকে নিয়ে মিডিয়ার কোনও মাতামাতিই ছিলনা।আড়ালে নিভৃতে থাকা এই কবির কবিতার
নির্মানশৈলী পরবর্তী দশকের কবি ও পাঠকের কাছে আলোচনাযোগ্য হয়ে উঠেছে।
তাঁর কবিতা পাঠের প্রাথমিক দিকে আমি সর্বপ্রথম প্রভাবিত হই যে কবিতা পড়ে,তার
পুরোটাই পাঠকের জন্য-‘ব্রায়ার পাইপ’ কাব্যগ্রন্থ থেকে-
“লোকটার/অপরাধ/ছাদে ওড়া জাতীয় পতাকা/চুরি করেছে/লোকটার অপরাধ/জামা
বানিয়েছে/বিচারে লোকটার স্বাধীনতা থাকছেনা।”(১৫ই আগষ্ট ১৯৮০)।কি অপূর্ব শিল্প কৌশলে অথচ সহজ সরল ভাষায় কবি কথাগুলো বলেছেন,মাথার উপর দিয়ে
বেরিয়ে যাবার কোনও সুযোগই নেই।‘স্বপ্নে উপকুলে’ কাব্যগ্রন্থ থেকে ভালো লাগা একটি
কবিতা- ‘আমি সারাদিন আমি’
“আমার মা সারাদিন মালা জপেন/আর আমি/আমারবোন সারাদিন ঊল বোনে/আর আমি/আমার বউ
সারাদিন আলনায় জামাকাপড় সাজায়/আর আমি/আমার প্রতিবেশীরা সারাদিন বাড়ী তোলে/ আর
আমি/আমার বন্ধুরা সারাদিন লিফটে চড়ে/আর আমি/আমি সারাদিন শুধু আমি শুধু আমি”।কবির এই কবিতা নিয়ে স্বাধীন স্বতঃস্ফূর্ত মতপ্রকাশে একথা
সকলেই মানবেন যে এমন সহজ সরল স্বীকারোক্তি ,কবির নম্র কথনে এ এক অসম্ভব জোড়ালো
কবিতা।বড় স্কেচের ছবি নয়,ছোট ছোট স্কেচ অথচ দর্শনে কোথাও একচুল ফাঁকি নেই।
তাঁর কবিতার বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মনে হয় ‘স্বপ্নে উপকুলে’ ‘ পিকাসোর
নীলজামা’ ‘মিড়’ ‘ব্রায়ার পাইপ’ । কবির
আত্মমগ্নতা ,স্বল্প পরিসরে গভীর প্রকাশ,উপস্থাপনায় পরীক্ষা নীরিক্ষা, প্রতিটি
কবিতায় তাঁকে বিশেষ করে তুলেছে।সহজ বাংলায় তাঁর বাইবেলের অনুবাদ (Old
Testament এবং new Testament)বাংলাদেশে এবং
এদেশে জনপ্রিয় হয়েছে।এজন্য পোপ জন পল তাঁকে নিজের হাতে সম্মানিত করেছেন।
‘ আগুনের বিবরন’ এই কাব্যগ্রন্থটি আমি পড়ি ,কবিযখন সদ্যপ্রয়াত হয়েছেন(১৬ই
এপ্রিলের পর).১৭ই এপ্রিল ঘুম ভাঙ্গতেই যখন দেখি ফেসবুকে সমগ্র নিউজ ফিড জুড়ে সজল
বন্দ্যোপাধ্যায়।শোকাহত অবস্থায় বইটি পড়ি।প্রতিটি কবিতাই আপাত সহজ সরল-প্রাঞ্জল
কিন্তু ভাবার্থে তার বিস্তার অনেক।‘শামুক’ কবিতাটি এই বইয়ের আমার সবচেয়ে
পছন্দের।চারপাশের কোন জগৎনিয়ে তিনি বেঁচে ছিলেন তা জানবার কৌতূহল রয়ে গেল,কেননা
তাঁর কবিতায় যে তারই বিবরণ ফুটে ওঠে।ভাল লাগুক না লাগুক তাঁর কবিতাকে উপেক্ষা করা
যায়না।শেষ করছি এক অসম্ভব ভাল লাগা দিয়ে।
“আমায় বিষ দাও/অমৃত বলে হাত পাতব-/আমায় অমৃত দাও/বিষ মনে করে পান করব-/আমায়
দুঃখ দাও/আনন্দের মত নেব-/আমায় যা দেবে দাও/মুঠো খুলেই রাখব-/আমায় ভালবাসা
দিয়োনা...” অথচ একবুক ভালবাসা দেয়ানেয়ার মাঝেই সজল বন্দ্যোপাধ্যায় চলে গেলেন।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment