Wednesday, July 6, 2016
“হাঁটতে হাঁটতে ভোর হচ্ছে”
“ছবি তুলছ/তোলো.../ ছবি কি বলে দেবে/ বৃষ্টি? রোদ্দুর?/ আমি হাসছি,/ তখন ভেতরে রক্তপাত।/ কাঁদছি/ তখন ভেতরে দাবানল।/ আমি ছবি না হওয়া পর্যন্ত/ কোন ছবিই সত্যি নয়/ সবই শুধু ছবি”।
----এই কথাগুলি লিখে যাওয়ার কিছু বছর পর, আজ যখন সত্যিই ছবি হয়ে গেলেন সজল বন্দ্যোপাধ্যায়, আমাদের প্রিয় সজল’দা---তখন তাঁর নানা টুকরোটাকরা পংক্তিমালা কুড়িয়ে সত্যিকারের মানুষটাকে খুঁজতে বসে সজল হয়ে উঠছি আবার। যে মানুষ চরম উদাসীনতা নিয়ে বলে উঠেছিলেন---“দিনের কোন মানে নেই/ রাতের কোন মানে নেই---/ শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা---/ কোন মানে নেই---/আসে যায় আবার আসে যায়।/ এক টুকরো জমি, এক টুকরো আকাশ---/ এক টুকরো হাওয়া, এক টুকরো আলো---/এক টুকরো শরীর, এক টুকরো মন---/ এবং/ এসব কিছু পাবার জন্য/ টুকরো টুকরো হয়ে গিয়ে/সব কিছুর মানে খোঁজা/ এবং/কিছুরই মানে থাকে না--/ একটা সুখ থেকে আরেকটা/ একটা কষ্ট থেকে আরেকটা...” তখন নির্জনতা ছেয়ে ফেলে শুধু। কষ্ট ছেয়ে ফেলে। যে কষ্ট কেবল একজন কবিজন্মের অভিশাপগ্রস্ত মানুষই টের পায়। “এখনবাংলা কবিতার কাগজ”কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে সজল বলেছিলেন একবার—“আমি মনে করি অনেক সহজ করে কঠিন কথা বলার জন্যই কবিতা। কবিতা বক্তৃতার জন্য নয়, কবিতা জ্ঞান দেবার জন্য নয়, দর্শনের জন্য নয়, শেষ পর্যন্ত কবির নিজস্ব অনুভব”।
“একটা পাঁচিল চাই। স্পর্ধার চেয়েও। চোখের ওপর বৃষ্টি পড়ছে যেন দেখতে না পায়। বুকের ওপর লাল পাপড়ি ঝরে পড়ছে, যেন কুড়িয়ে নিয়ে নিজের হাতে লাল না করে। সকলে আসুক, দাঁড়িয়ে থাকুক। পোষা বেড়ালের লোম সারা ঘরে ছড়িয়ে থাকুক। গলার শব্দ যেন শুনতে না পায়। গান বলে ভুল না করে”।
যাবতীয় নিষেধ স্পত্ত্বেও পংক্তিগুলো গানের মতই বাজতে থাকে। সজল বন্দ্যপাধ্যায়ের ভরাট গলায় রবিগানের মতই। মাথার মধ্যে সজল মেঘের কালো কালো অক্ষর ঝরে পড়তে থাকে ঝমঝম। সোজাসুজি স্পষ্ট চোখে গভীর তাকিয়ে নিচু স্বরে উচ্চারণ করা অনুভুতির সামনে আপনা থেকেই মাথা নত হয়ে আসে। পাঁজরের নীচের লাল থেকে মগজের ধূসর বস্তু অবধি প্রবহমান হয় এক সুরতরঙ্গ।
“হয়ত কিছু বলার ছিল। ঘরের মধ্যে ঝড়। ঘরের মধ্যে মাঝে মাঝে আলো।নিজের কথা না বলেই যদি কিছু বলা যেত...। যখনই কিছু বলতে যাই, গানের মধ্যে, হাওয়ার মধ্যে আমার কণ্ঠস্বর......। সবই বলা হয়েছে, বলার মত কিছুই ছিলনা”।
চারপাশের চেনা দৃশ্যজগত যে কত বহুমাত্রিক, সজল বন্দ্যপাধ্যায়ের কবিতা যেন সেই সত্য আবার দৃঢ়তায় প্রতিষ্ঠিত করে। হৃদয় পেতে, কান পেতে, মেধা ও মনন মেলে রেখে বারবার সহজ সরল পংক্তিগুলোর কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। সজলের কবিতা আমাকে লাটাই ও ঘুড়ির এক যৌথ রসায়ণের দিকে নিয়ে যায়। আকাশ পর্যন্ত টানটান সুতো যেন অবলীলায় লাটিমবন্দী করে ইচ্ছে ঘুড়িকে হাতের মুঠোয় আসে, আবার উড়িয়ে দেয়। দৃশ্যপট, চিত্রকল্প, ভাষাবিন্যাস, শব্দবন্ধ সবই সজলের হাতে সংহত এক জাদু লাটিমের ভাঁজে। বহির্জগতে ছুঁড়ে দিয়েই অন্তর্লোকে ফিরে আসা। ঘুড়ি যেমন সত্যি আকাশ ছোঁয় না, মনে হয়—এই ছুঁলো বুঝি; সজলের কবিতাও তেমন এক নির্দিষ্ট লক্ষ্যের সীমানা কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে পাঠককে ছেড়ে দেয়।
“ঘড়ির হাত/ রাত বারোটা/ছুঁয়ে যায়--/ মানুষের হাত/শুধু চায়/ ছুঁতে পারে না”। রাত বারোটা ছুঁতে চাওয়া---কি সেই রাত বারোটা? কোন শীর্ষবিন্দু? মনোজগৎ ও বস্তুজগৎ, চেতন ও অবচেতন, বাস্তব অ পরাবাস্তব---এমত নানাবিধ দ্বৈত অনুষঙ্গ মিশে এক হতে চাওয়া কি? যেভাবে দুটো অসম কাঁটা মিশে এক হয়ে যায় রাত বারোটায়? রাত কেন, কেন দিন নয়? কেন না অন্ধকার। কেন না নির্জনতা। নিশিডাক। স্তব্ধতায় ডুবে যাওয়া। সজলের নিজের কথায়---“রাতে ছায়ায় পা দেখা যায় না/ রাতে জল ছায়া হয়ে যায়/ রাতে চোখে ছায়া নামে/ রাতে শরীর ছায়ায় ডুবে যায়”। ---এই ছুঁতে চাওয়াটাই বিষয়। এই দৃশ্যমান পৃথিবীর---পুরনো একটা সূর্য, বুড়ি চাঁদ, ক্লিশে মেঘবৃষ্টিহাওয়া আর ভালোবাসা নামক দূরারোগ্য এক কালব্যধি---কত রকমভাবেই না বেঁচে থাকাটা লবণাক্ত করে দেয়। আর এসমস্ত কিছুর আড়ালে যে অদৃশ্যমান চেতনার জগৎ, সেই দুইয়ের মধ্যে সাযুজ্য রেখে সজল এক নিভৃত আত্মসমাহিত মগ্ন আবহের শিল্পী যার প্রত্যিহিকের ব্যবহৃত পাঞ্জাবীর মধ্যে অনায়াসে আত্মগোপন করে থাকে “পিকাসোর নীল জামা”।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment