Wednesday, July 6, 2016
সজল বন্দ্যোপাধ্যায়
একটি পারিবারিক দর্পণ
‘তৃষ্ণা আমার তরী’
বইটি প্রকাশ পেয়েছিল গতশতাব্দীর ছ’য়ের দশকের গোড়ায় গ্রন্থজগৎ প্রকাশনা থেকে।এখান
থেকেই তারই কিছু আগে পরে প্রকাশ পাচ্ছে ‘হে প্রেম,হে নৈঃশব্দ’,’ফিরে এসো চাকা’, ‘
অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি,অন্ধকারে’, বা এইরকমই স্মরণযোগ্য আরো কিছু বই।গ্রন্থজগৎ-এর
কর্ণধার দেবকুমার বসু-র সূত্র ধরে এইসব বইগুলি একটা করে কপি আমাদের বাড়িতে
আসত।আমার কবিতা পড়ার দীক্ষিত হয়ে ওঠার সময়টুকু, সাতের দশকের শেষ বাঁ আটের দশকের
শুরু,তখনো সেভাবে কবিতা লিখব কখনো ভাবিনি,আমার প্রিয় বইগুলির অন্যতম ছিল ‘তৃষ্ণা
আমার তরী’-যা বারবার পড়তাম আর সেই বয়েসে ভিতরে একটা অদ্ভুত দোলা অনুভবকরতাম। আমার
বয়স তখন আঠেরো উনিশ।
কবি সজল
বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেই আমার পরিচয়ের শুরু।
কিন্তু
সজলকাকা।তাঁকে তো আমি জানি আমার পরিবারের একজন বলেই সেই আমার শৈশবের উন্মেষ
থেকে।চন্দননগরে থাকতেন তখন।এক একটা ছুটির দিন সকাল সকাল বাবা-মা’র
সঙ্গে চন্দননগর স্টেশন।স্টেশনের ঠিক পাশেই ওনার বাড়ি।তখন সবে সকাল হয়েছে,বাবা
বাড়ির সামনে গিয়ে স জ ল আলাদা ভাবে উচ্চারণ করে ডাকতেন আর খালি গায়ে লুঙ্গি পরিহিত
সজলকাকা নেমে আস্তেন,সঙ্গে অনেক গুলো পোষা কুকুর।এই কুকুরগুলোর সাথেই তারপর আমার
সারাদিন মেতে থাকা।বাবা,মা,সজলকাকা হয়তো আরো কোথাও বেড়াতে চলে গেলেন,কিন্তু আমি
রয়ে গেলাম।ওনার বাবা মা’র কাছে।যাদের আমি দাদু আর ঠাকুমা বলতাম।পরে
বাবার কাছে শুনেছি একটা ফরসা টুকটুকে ছেলে, সবে ম্যাট্রিক পাশ করেছে,একদিন একটা
বই-এর পান্ডুলিপি নিয়ে এলো।চন্দননগরের পাশের স্টেশন মানকুন্ডুর তেলেনীপাড়ায় তখন
থাকতেন বেচু পরামানিক।যিনি সম্রাট সেন নামে উপন্যাস লিখে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।তিনিই
পাঠিয়েছিলেন।বইটা পড়ে বাবার ভাল লেগে গেল।সেই পান্ডুলিপিই ‘তৃষ্ণা আমার তরী’,যা
তাঁর কুড়ি বছর বয়েসের আগেই প্রকাশ পেয়েছিল।
এরও কিছু পড়ে, বোধহয়
৬৮-৬৯ সাল হবে,আমার ঠিক মনে পড়ছে না,আমাদের বাড়িতে হুলুস্থুল,বেশ কিছু লোকের
সমাগম।বাবা প্রায় ইলোপ করার মতন করে একজনকে নিয়ে এলেন।তখনকার সময় অনুসারে
অল্পবয়েসী একটি মেয়েই বলব।আমাদের
বাড়িতে অনেকের সাথে সজলকাকাও ছিলেন।আমার সেই বয়েসে কিছু বোঝা আর নাবোঝার মধ্যে
এটুকু বুঝলাম সেদিন সজলকাকার বিয়ে।আমাদের বাড়িতে রেজিস্ট্রার এসে অপেক্ষা
করছিলেন।পাত্রীর বাবার এই বিয়েতে মত নেই।প্রায় গৃহ-বন্দী করে রেখেছিলেন
পাত্রীকে।যেন আমার মা তার সহপাঠী,ক্লাস নোট নিতে এসেছে এই অজুহাতে পাত্রীর বাড়িতে
তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বাবা সটান তাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে হাজির।সেই বিয়ের
রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট,যা সজলকাকার কাছেও ছিল না,দীর্ঘ দীর্ঘ দিন পরে আমার
বাবার পুরোনো ফাইল থেকে উদ্ধার হয় ২০১০সাল নাগাদ।আমি আর মা গিয়ে সজলকাকাকে ওনার
বাড়িতে দিয়ে আসি।
এইরকম যাঁর সাথে
সম্পর্ক,তিনিতো কবি পরিচয় ছাপিয়েও আমার কাছে পরম আত্মীয়ের মত।ছ’য়ের
দশকের শেষ,সাতের দশকের শুরু,মাসিক কবিতা পত্রিকা ‘সময়ানুতা’কে
কেন্দ্র করে তরুণ কবিদের আড্ডা তখন রমরম করছে।সেইসব আড্ডায় কবিতা পাঠ ছাড়াও
অবধারিত ছিল সজলকাকার কন্ঠে রবীন্দ্রগান আর অজিত পাণ্ডের গণসঙ্গীত।প্রায় সাত-আটশো
রবীন্দ্রসঙ্গীত ওনার মুখস্ত ছিল।কেউ গান শুনতে চাইলে কোনদিন না করতে শুনিনি।
প্রথম বই গ্রন্থজগৎ
থেকে প্রকাশ পাবার পর ওনার দ্বিতীয় বই প্রকাশ পায় আনন্দ পাবলিশার্স থেকে।বেশ কয়েক
বছরের ব্যবধানে।গ্রন্থজগৎ প্রকাশনা তুলে দিয়ে টেমার লেন –এ ৬৮সাল নাগাদ
দেবকুমার বসু শুরু করলেন বিশ্বজ্ঞান প্রকাশনা।সজলকাকা এরই কাছাকাছি সময়ে চন্দননগর
ছেড়ে কোলকাতায় চলে আসেন।বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন নাকতলায়।শুরু করেছেন সেন্ট জেভিয়ার্স-এ
পড়ানো।বৃহস্পতিবার ছুটি।চলে আসতেন বিশ্বজ্ঞানের আড্ডায়।ওখানে পরেশ মন্ডল,পুষ্কর
দাশগুপ্ত,উত্তম দাশ থেকে শুরু করে ছ’য়ের দশকের ও শ্রুতি আন্দোলনের
অনেক কবিই আসতেন।
ওনার কবিতা ততদিনে
পাল্টাতে শুরু করেছে।ওনার বহু পাঠিত কবিতা ‘আমি’(আমার স্ত্রী
সারাদিন কাপড় মেলেন/আমার মা......ইত্যাদি,যার শেষ পংক্তি আমার সারাদিন আমি,শুধু
আমি) তখন জনপ্রিয় হচ্ছে।বিভিন্ন কবিতা পাঠের আসরে তিনি এই কবিতা পড়তেন।এইযে বদল,যা
আমরা ওনার ব্রায়ার পাইপ পর্বের সূচনা বলতে পারি,এক অন্য সজল বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমরা
পাচ্ছি,যাঁর কবিতায় আস্তে আস্তে ঢুকে পড়ছে ফরাসী কবিতার প্রভাব।অল্প কিছু শব্দ এমন
ভাবে নির্মাণ করা যাতে একতা চিত্রকল্প ফুটে ওঠে।কোন বড় বাক্যবন্ধ নয়,কিছ শব্দের সমাহার,যেন
এই শব্দ সাজানোটাই খেলা।একজন কবির পক্ষে অবশ্যই এ এক বড় ঝুঁকি,তিনি প্রচলিত
অভ্যস্ত পথে যেখানে সাফল্য তাঁকে ছুঁয়েই ছিল,তার থেকে বেরোতে চাইলেন।নিজস্ব
কমফোর্ট জোনের মধ্যে না থেকে চেষ্টা করলেন নতুন ভাষা,নতুন ভাবে বলার।এতো নিজেকেই
ভাঙা।আর এই ভাঙার জন্যই কবি হিসেবে নিজেকে উত্তীর্ন করলেন সমসাময়িকতার
বাইরে।সমসাময়িকতাকে অতিক্রম করে।যে কারণে আজো তাঁর কবিতার আলোচনা জরুরী হয়ে পড়ে,
একেবারে নতুন প্রজন্মের কাছেও।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment