• গল্পনা


    গল্প নয়। গল্পের সংজ্ঞাকে প্রশ্ন করতে চায় এই বিভাগ। প্রতিটি সংখ্যায় আপনারা পাবেন এমন এক পাঠবস্তু, যা প্রচলিতকে থামিয়ে দেয়, এবং নতুনের পথ দেখিয়ে দেয়।


    সম্পাদনায়ঃ অর্ক চট্টোপাধ্যায়
  • সাক্ষাৎকার


    এই বিভাগে পাবেন এক বা একাধিক কবির সাক্ষাৎকার। নিয়েছেন আরেক কবি, বা কবিতার মগ্ন পাঠক। বাঁধাগতের বাইরে কিছু কথাবার্তা, যা চিন্তাভাবনার দিগন্তকে ফুটো করে দিতে চায়।


    সম্পাদনায়ঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায় ও তুষ্টি ভট্টাচার্য
  • ক্রোড়পত্র - কবি সজল বন্দ্যোপাধ্যায়


    শ্রুতি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা কবি সজল বন্দ্যোপাধ্যায়। এই কবির জীবন, ভাবনা এবং বেশ কিছু নির্বাচিত কবিতা নিয়ে এ সংখ্যার বিশেষ ক্রোড়পত্র।


    সম্পাদনায় - অতনু বন্দ্যোপাধায়
  • কবিতা ভাষান


    ভাষা। সে কি কবিতার অন্তরায়, নাকি সহায়? ভাষান্তর। সে কি হয় কবিতার? কবিতা কি ভেসে যায় এক ভাষা থেকে আরেকে? জানতে হলে এই বিভাগটিতে আসতেই হবে আপনাকে।


    সম্পাদনায় - শৌভিক দে সরকার
  • অন্য ভাষার কবিতা


    আমরা বিশ্বাস করি, একটি ভাষার কবিতা সমৃদ্ধ হয় আরেক ভাষার কবিতায়। আমরা বিশ্বাস করি সৎ ও পরিশ্রমী অনুবাদ পারে আমাদের হীনমন্যতা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরটি সম্পর্কে সজাগ করে দিতে।


    সম্পাদনায় - অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
  • এ মাসের কবি


    মাসের ব্যাপারটা অজুহাত মাত্র। তারিখ কোনো বিষয়ই নয় এই বিভাগে। আসলে আমরা আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কবিকে নিজেদের মনোভাব জানাতে চাই। একটা সংখ্যায় আমরা একজনকে একটু সিংহাসনে বসাতে চাই। আশা করি, কেউ কিছু মনে করবেন না।


    সম্পাদনায় - সোনালী চক্রবর্তী
  • হারানো কবিতাগুলো - রমিতের জানালায়


    আমাদের পাঠকরা এই বিভাগটির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন বারবার। এক নিবিষ্ট খনকের মতো রমিত দে, বাংলা কবিতার বিস্মৃত ও অবহেলিত মণিমুক্তোগুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে আনছেন, ও আমাদের গর্বিত করছেন।


    সম্পাদনায় - রমিত দে
  • পাঠম্যানিয়ার পেরিস্কোপ


    সমালোচনা সাহিত্য এখন স্তুতি আর নিন্দার আখড়ায় পর্যবসিত। গোষ্ঠীবদ্ধতার চরমতম রূপ সেখানে চোখে পড়ে। গ্রন্থসমালোচনার এই বিভাগটিতে আমরা একটু সততার আশ্বাস পেতে চাই, পেতে চাই খোলা হাওয়ার আমেজ।


    সম্পাদনায় - সব্যসাচী হাজরা
  • দৃশ্যত


    ছবি আর কবিতার ভেদ কি মুছে ফেলতে চান, পাঠক? কিন্তু কেন? ওরা তো আলাদা হয়েই বেশ আছে। কবি কিছু নিচ্ছেন ক্যানভাস থেকে, শিল্পী কিছু নিচ্ছেন অক্ষরমালা থেকে। চক্ষুকর্ণের এই বিনিময়, আহা, শাশ্বত হোক।


    সম্পাদনায় - অমিত বিশ্বাস
  • ধারাবাহিক উপন্যাস


    বঙ্কিমচন্দ্র


    অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত

Wednesday, July 6, 2016

রমিত দে

একটা অসনাক্ত আলো আর ব্রায়ার পাইপ হাতে নেওয়া লোকটাঃ সজল বন্দোপাধ্যায়
               

তারপর? সব কথা হয়ে যাওয়ার পরও কি কবির কাছে পড়ে থাকে এমনই কিছু প্রিয় তারপর!এমনই কিছু সুবোধিনী বুদ্ধশরীর যা তাকে পোড়ামাটি রঙে রাঙায়, প্রতিকৃতিতে গড়েপরিত্রান পেতে তো চাননা বরং এক স্নিগ্ধ সাফারিংসের দিকে তাঁর আস্বাদনের আঙুল তোলেনআর সেই দৃশ্যের পারম্পর্য ডাকতেই কবি চলেন অনু থেকে অনুপমে,চলেন নিগুঢ়তমের দিকে,নিঃশব্দ নির্মাণের দিকেআসলে কিছু বলার পর কিছু না-বলার একটা মোহ তো থাকবেই,তাই তো তিনি মধুরমধুরং থেকে অবলিক একটা কম্যুনিকেশন টেনে রাখেন আরও কিছু মাত্রাহীন মাপের দিকে, মৌনতার দিকে। প্রতিমূর্হুতে কবি চাইছেন তাঁর কন্ঠতটে অবিরাম অধিষ্ঠিত থাক একটা না বলা একটা না শোনা স্টিল লাইফ, একটা কায়ব্যুহরূপ আর সৃষ্টির প্রেক্ষিতে এই সেই চির তৃষ্ণার্ত আরও একটা তারপর ! প্রতি মূর্হুতেই কবি যেন সুস্পষ্ট সর্বাঙ্গীন থেকে জানলাটা আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলছেন অর্থহীনতার দিকে প্রথার যৌথশালায় সচেতন মুখ ফুটে উঠলেই নিভিয়ে দিচ্ছেন অনুসরনপ্রিয়তার আলো সজলও তো উঠে এলেন মধুরিপু থেকে মৌ-এ ধোওয়া এমনই অর্থবিমুক্ত বধির মেদুরের দিকে কবিতার সেবাকে পুনর্বাসনের স্রোতে ভিজিয়ে দিলেন বাংলা কবিতার নতুন ট্যুরিস্ট না, আর ঘুম নয়,বাংলা কবিতার প্রবীন খনিতে  বুকজোড়া নিঃশ্বাস যে নিতেই হবে,সজল বুঝেছিলেন, বুঝেছিলেন শব্দের মত দুর্লভ প্রজাতিকে বাঁচাবার কমাত্র উপায় বোধের নতুন এক জানলার স্থানাঙ্ক নির্নয় করা। স্বাধীন ভাষার খোঁজে বাংলা কবিতার মহাকাব্যিক মিথ ছিঁড়ে বারবার এই জানলাটার কাছেই আসতে চেয়েছিলেন সজল বন্দোপাধ্যায় ,আর এখানে দাঁড়িয়েই বারবার তাঁর প্রশ্ন ছিল- জানলার পরেও কি কোন জানলা আছে? তাও কি বন্ধ! তাও কি খোলা যায় না! জানি না জানলাটা বন্ধ আছে খুলতে হবে কে বলতে পারে বাইরে শিশির বাঁধানো উঠোনে নিজের হারানো মুখ পড়ে আছে কিনা কিংবা হয়তো বা জানলাটা খুললেই দেখতে পাবো উপকূলে আমি দাঁড়িয়ে আছি আর প্রতিটা ঢেউয়ের চূড়োয় আমার নিজের মুখ, আকাশের চেয়েও নিঃশব্দ,জ্যোৎস্নার চেয়েও রূপালী,সমুদ্রের চেয়েও অস্থির আমার মুখ,আমার নিজের হারিয়ে যাওয়া মুখ“—সজলের যাত্রাপথের বিরাট রহস্যে,তার খেলাঘরের অতি আশ্চর্য্যে,তাঁর গুপ্ত ভাঁজে ভাঁজে তাঁর গুহ্যভাষনে ঢুকে পড়া যাক ওই খোলা জানলাটা দিয়েই;কিন্তু কোন দিক দিয়ে ঢুকব এই মহৎ শূন্যস্থানে! প্রথাগত ছক সর্বস্বতাকে যে বারবার খুন করতে চেয়েছিলেন সজল; শব্দকে তার তালগোল পাকানো পিন্ড থেকে বারবার পরিণত করতে চেয়েছিলে সময়প্রকীর্ণ একটা শূন্যে। শিল্পের অধিকার প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-শিল্পের অধিকার নিজেকে অর্জন করতে হয় পুরুষানুক্রমে সঞ্চিত ধন যে আইনে আমাদের হয় তেমন করে শিল্প আমাদের হয় না কেননা শিল্প হলো নিয়তিকৃতনিয়মরহি্তা;বিধাতার নিয়মের মধ্যেও ধরা দিতে চায় না সে নিজের নিয়মে সে নিজে চলে, শিল্পীকেও চালায়, দায় ভাগের দোহাই তো তার কাছে খাটবে না হ্যাঁ,শিল্পধর্মের শরনার্থী হয়েও সজল বন্দোপাধ্যায় বারবার কালো রাবারে মুছে দিতে চেয়েছিলেন শিল্পীর গায়ে পক্ষাঘাতের মত লেগে থাকা শব্দের দায়ভারটুকু , মুছে দিতে চেয়েছিলেন শিল্পের প্রথাগত মূক বধির প্রতিমার শব, যেন প্রমা করতে চাইলেন একটা থাকা, একটা নিরন্তর সেজে ওঠা, একটানা অভ্যেস পেরিয়েও শব্দের মধ্যে পড়ে থাকে একটা আত্যন্তিক শূন্যতা,যে শূন্যতা চিনিয়ে দেবে চেনাশোনা বৃত্তের বাইরের অন্ধিসন্ধিটুকু।সবটুকু আবহাওয়া শব্দের মধ্যে দিয়েই তাই সরে এলেন সন্তপর্ণে নির্জন স্থির নিশ্চুপ অস্পর্শের দিকে। ছোটোছোটো আইডেনটিটি মিসরিকোগনাইজডগুলোর মধ্যে দিয়ে ছোটো ছোটো মৌলিক তৃষ্ণার মধ্যে দিয়ে বারবার বাংলা কবিতার তথাকথিতকে অস্বীকার করাই ছিল সজলের রুবিক পৃথিবী। কবিতা কি? তার নাতিদীর্ঘ কোনো গাণিতিক মাপজোক তো কোনোকালেই ছিলনা, সময় ও সংস্থানের মধ্যে দিয়ে বহুস্বরিক ব্যক্তিপ্রতিবিম্বে ঠিক এটাই ছিল তাঁর ক্রমজিজ্ঞাসা। সজল বন্দোপাধ্যায় সেই  পর্যবেক্ষনের পাখি, যা বারবার উড়ে যেতে চেয়েছে নগ্নতা থেকে আরও এক গভীর নগ্নতায় , সীমারেখাকে সিগনিফাই না করে সীমারেখাকে এনকাউন্টার করেছেন বাংলা কবিতার নির্দিষ্ট এলাকাতে দাঁড়িয়েও নিয়ত অন্বেষনেই সজল ছিল ভীষন ভাবে জ্যান্ত , বোধের কোনো নিশ্চিত টেক্সচারে স্বীকার্য হতে চাননি সেখানে, বারবার বলতে চেয়েছেন-“Before the cock crows twice, you will deny me three times”

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোথা থেকে শুরু করব সজল বন্দোপাধ্যায়ের মত অনির্ধারিত সুরকে,শিল্পের হাটভাঙা শিল্পকে!আবার একটু অবন ঠাকুর প্রসঙ্গে আসি দৃষ্টি ও সৃষ্টি প্রসংগে অবনীন্দ্রনাথকে যেখানে বলতে শোনা গেল-লক্ষ্য করবার জন্যেই হল চোখ, শব্দ ধরবার জন্যেই হল কান, হাত পা রসনা সব কটাই হল রূপ রস স্পর্শ গন্ধ ধরে বিশ্বের চারিদিককে বুঝে নেবার জন্য আর সেখানেই সজল বন্দোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতায় স্ফুট হ এক নতুন নির্মামহল -না থাকার একটা থাকা - যা দেখিনি/তার  জন্য অন্ধ/যা ছুঁইনি/ দুঃখ……যা বলিনি/বন্ধ ঘরযা শুনিনি/কান ছিল না……যা লিখিনি/তার জন্য/মৃত্যু……(অভিজ্ঞতা/ব্রায়ার পাইপ) আসলে শব্দের জেগে থাকাটুকু সজলের ভাবনাবৃত্ত নয়,অক্ষরের মাঝেই অ্যালিয়েনেশন খুঁজেছেন ভাবদ্যোতকতায়,স্বরধ্বনির বৈপরীত্যে ঠিক যেমন রক্ত ক্ষরণে ক্রমে ক্রমে শুকিয়ে জমাট হয়ে যাওয়া রক্তের নাম তাঁর কাছে হয়ে উঠেছে  স্মৃতি, একটা না থাকার ভেতরেই ক্রমাগত প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন একটা দ্বিতীয় থাকা, মাপতে মাপতে এসে পড়েছেন ভাবের ভেতরের অভাব অবধি ,ফলে এজাতীয় নিরীক্ষাকে কতটা তত্ত্বে যাবে কতটাই বা কথার পুঁজিতে তা জানা নেই , বরং নীরবতাতেই সে যেন নির্ধারিত , নিশ্চয়িত। কিন্তু এ সজল শ্রুতির ফসল শ্রুতিপর্বের আগের সজল ছন্দে নির্বাসিত,অলংকার উপমায় সম্মোহিত, সেখানে পঞ্চাশের আশ্রয়মাস্তুল,ব্যকরণের অধীনতা আর মিল কবিতার সমমাত্রিক চরনের ব্যবহার, প্রথম কাব্যগ্রন্থ তৃষ্ণা আমার তরী থেকে কিন্তু সজলের নিজস্ব কাব্যভাষা তৈরী হয়নি,বরং পঞ্চাশের রোমান্টিকতা বা দলবৃত্ত ছন্দের চপল প্রকরণেই কেটেছে কবির প্রথম প্রহরটুকুসাথে সাথে টানা গদ্যের পংক্তিগুলি তাঁকে বারংবার আকর্ষণ করেছে ইমেজিস্ট নির্মিতির দিকে, সে সব গদ্যকবিতায় শব্দের চিহ্নায়িত প্রিন্সিপাল রয়েছে, প্রচেষ্টা রয়েছে কাব্যের সনাতনী প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার ;কিন্তু ভাঙ্গনেঅনুমোদন সেভাবে নেইতবে যাঁর প্রথম কবিতার বইতৃষ্ণা আমার তরী’, প্রবাহমানতা নিয়েই যে তাঁর সহজাত উড়ান সেটাই স্বাভাবিক আর তারই ফলশ্রুতি ১৯৬৬ এর তৃষ্ণা আমার তরী থেকে ১৯৮৬ এর ভ্রমণ-প্রায় তিন দশকে বয়ন থেকে ব্রহ্মরন্ধ অবধি কবিতার ছাই মেখে ঘুরে বেড়ানো সন্ন্যাসী সজল তিনি ক্রমাগত উত্তোরিত হয়েছেন নিত্যশব্দময় কবিতার সামান্য প্রয়োজনীয়তা থেকে এক পেরিপ্যাটেটিক পিলগ্রিম হিসেবে ,উচ্চারনের গৃহলক্ষী ছেড়ে খুঁজে ফিরেছেন উৎকর্ষের গবেষককে স্থবিরপ্রায় হলেও টানা গদ্যের স্মৃতি,আলো নিভে গেলে,বয়া,চাঁদ সূর্য তারা চন্দ্রমল্লিকা বা গীর্জের চূড়ো কবিতাগুলি থেকেই উপলব্ধি করা যায় প্রথম বই থেকেই পুরোপুরি স্থায়ী হতে চাইছিলেননা সজলতাঁর পথ যে আদতে ক্রমশ মিথ ভাঙার দিকে তাও উপলব্ধ হচ্ছিল কেবলমাত্র প্রতীকের সনাক্তকরণের মধ্যে দিয়ে তো কবিসত্তার সম্পূর্ণতা সম্ভব নয়, প্রতীকের মধ্যে দিয়ে আদ্যন্তহীন পথটা ঠিক কোনদিকে ! কিভাবে ঢুকব সে পথেপ্রথম বই থেকে এ প্রশ্নটাই সজল তুলে দিয়েছিলেন নিজের হাতে আর মগজের এই ঝাঁকুনির ফলে তাঁর সমস্ত বলার মধ্যে সে সময়ও ছিল একটা প্যারালেল সাইলেন্স, আলো-অন্ধকার একই সাথে ওঠানামা করছে সেখানে, একই সাথে অনুগামী হচ্ছে একাধিক শূন্যসেই প্রথম কবিতাকাহিনীতে ঢোকা যাক, ছেষট্টির সজলের পাঁজরে রাখা যাক একজন সামান্য পাঠকের হাত

রক্ত ক্ষরণে ক্রমে ক্রমে রক্তটা শুকিয়ে জমাট হয়ে গেল আহত লোকটা তার নাম দিল স্মৃতিতারপর সারাক্ষন ধরে ঐ স্ম্রৃতির দিকে গভীর অভিনিবেশে চুপচাপ তাকিয়ে রইলওর রক্তের সঙ্গে ওর কি নিবিড় সম্পর্কআমি দেখলুম সারাক্ষন স্মৃতির দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য লোকটাকে কেমন পাথরের মত দেখাচ্ছেলোকটা যেন রক্তেরই মত জমাট হয়ে যাচ্ছে আমার মনে হলো ঐ আহত লোকটার নামও স্মৃতি -

চক্ষুঃশ্রবা স্বপ্নের ভেতর লেখক যেন তখন থেকেই জেগে আছেন আত্মউচ্চারনের উতল অহং-নিয়ে, যা তাকে নিয়ে যাবে সম্পূর্ণতার দিকে , যা তাকে অন্যনির্ভর করবে ,কবিতার জমা জলে কিছুটা ঝুঁকে কেবল নাড়িয়ে যাচ্ছেন চিরন্তন স্পৃহা ,সন্তরণের স্পর্ধা, দরজার ভেতর খুলে দিচ্ছেন আর একটা দরজা আর একটা ছবি আরও এক চলমানতা বিদিত থেকে অবিদিতের দিকে সজলের এই খিদেয় কেবলমাত্র ব্যক্তের কসমেটিক্স নয় বরং অব্যক্ত কণাদের ইঙ্গিত সে সময়  থেকেই পরিষ্কার হয়ে উঠছিল " ভেসে গেল বয়াসাত রাত্রি সাত দিন মাছগুলি অন্বেষনে ঘুমালো না,আহার্যের কণাগুলি রয়ে গেল বঁড়শীর মুখে -এমনই সব শব্দের পিপাসা এসে , শিল্পের বিচিত্র প্রসববেদনা এসে বারবার সজলকে ধরতে চেয়েছে, তাঁকে নিয়ে গেছে উচ্চারিত দ্বিতীয়তার দিকে শ্রুতি ৭ম সংকলনে সজল বন্দোপাধ্যায় তাঁর নিরীক্ষায়নের উচ্চারণে বলেন-ভাষা যে লৌকিক জগতের অর্থের সীমায় সংকুচিত,আবদ্ধ তথাকথিত বাস্তবের প্রয়োজনে বহু ব্যবহৃতআত্মাবিষ্কার করতে করতে যখন সেই অভিজ্ঞতা লিখে রাখতে যাই,মনে হয় ঠিক বলা হল নাযা পবিত্র,আন্তরিক তা আন্তরিকতার আবরণেই নিজেকে ঘিরে রাখে,যা রহস্যময় তাকে রহস্যময়তার মধ্যে দিয়েই ব্যক্ত করতে হয়আমার মধ্যে আছে অন্তহীন রহস্যের জগততাকে প্রকাশ করতে হলে তার উপযুক্ত ভাষা আমায় গড়ে নিতে হবেলৌকিক ভাষাকে আমি কি করে অলৌকিকের পরিবাহক করে তুলব? লিখি, আবার পাল্টাইবারবার মনে হয়, না, আমার রহস্য অভিজ্ঞতাকে ঠিক প্রকাশ করতে পারছি নাবোধহয়, Duende-র মত যাদুকরী শক্তির দাক্ষিন্য যদি পাই আমার জগতকে ঠিকভাবে ব্যক্ত করতে পারব আমি তো লৌকিক জগতের রূপ ভাষায় ফোটাতে যাচ্ছি নাআমি সেই জগতকে রূপান্তরিত করে নিতান্তই আমার করে তুলছিতারপর তাকে দেখে যে অভিজ্ঞতা, তার যে আবেদন আমি উপলব্ধি করছি তাকেই ভাষায় রূপ দিতে চাইছি  চোখে দেখা ছবি আঁকতে আঁকতে কখন যেন সজল বন্দোপাধ্যায় ছবির ভেতরই খুঁজে পেলেন নতুন এক বিরোধাভাসের চিত্র। সে দেখা আত্মাবিষ্কারঅনিঃশেষ নতুনের দেখা।১৯৬৬ তে প্রথম বই তৃষ্ণা আমার তরী; তারপর দীর্ঘ এগারো বছর পরে বেরোলো স্বপ্ন উপকূলে(১৯৭৭)একে একে পিকাসোর নীল জামা(১৯৭৯),মিড়(১৯৮১),ব্রায়ার-পাইপ(১৯৮৪),বা ভ্রমন(১৯৮৬)-একধরনের ট্যানজিবেল ডিল্লেমাই সজল বন্দোপাধ্যায়কে দিয়ে ক্রমাগত লিখিয়ে নিল এক থেকে অন্যতর। দীর্ঘ এগারো বছর ধরে আমরা সজল বন্দোপাধ্যায়ের কবিতার বিশ্লেষণ করলেই দেখব শব্দের বিশ্বাস থেকে বিস্ময় কীভাবে নির্যাস হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতায়। এগারো বছর জুয়াঘরের পেছনে ছিলেন সজল,যেন নিজেকে রিলেট করতে চাইছিলেন, চেতন অবচেতনের মাঝে সেলফ ডিকনস্ট্রাকশন করতে চাইছিলেন, আর তাই তাঁর কবিতার গাঢ় ভাষা হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে।


একজন কবির অগ্রন্থিত সফরের মধ্যেই তার মনস্তত্ত্বের উন্মোচন অর্থাৎ কবিতার হাত ধরে জীবনের মধ্যে দিয়ে যে ক্যালিগ্রাফিক জার্নি তাই ছিল সজলের কবিতা। নবীন কবিকে লেখা চিঠিতে রাইনের মারিয়া রিলকে যখন বলেন-“There is only one thing you should do. Go into yourself. Find out the reason that commands you to write; see whether it has spread its roots into the very depths of your heart; confess to yourself whether you would have to die if you were forbidden to write. নিজের জীবনকে কবিতার জন্য তৈরি করো জীবনের প্রতিটা মূহূর্তকে উৎসর্গ করোনগণ্য থেকে নগণ্যতম সময়গুলোও সাক্ষী থাকুক তোমার তীব্র অন্তর্দহনেরহ্যাঁ,এগারো বছর ধরে নিজেকে এভাবেই  জারিত করেছেন সজল, মুখোমুখি হয়েছেন ভিতর ভাষ্যের সামনে নতুনভাবে বলার চেষ্টা করেছেনশব্দের নশ্বরতাকে এনকাউন্টার করেছেন,খুঁজেছেন দুটো ফাঁকের মাঝখানে আর একটা কিছু, একটা নেসেন্ট ভ্যালুকেআপোষহীন প্রচারবিমুখ সজল বন্দোপাধ্যায়কে আমরা আজন্ম ভিক্ষুক থাকতে দেখি শব্দের অনাথপিন্ডদের কাছে। ব্যক্তিগত শৈলীতে সজলের কাছে বিটউইন দ্য অ্যাপিয়ারেন্সই ছিল কবিতার কাঙ্খিত ক্ষেত্রফল কবিতাকে করেছেন ওপেন ও আনরিড, অ্যালাইমেন্টকে ভেঙে দিয়েছেন শব্দ ও অক্ষরের মাঝে স্পেস দিয়েকিন্তু আঙ্গিক বিন্যাস দৃশ্যাবলী বা গন্তব্য প্রসঙ্গে আমরা পরে আসব,বরং দেখা যাক সেই শ্রুতিকে যা সজলকে করল সেতুভাসি,বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে এক নবীন বাগ্মীকে দিল অনুশীলনের উর্বর বাঙ্কার,যেখান থেকে একমাত্র প্রকৃত কবিই তাঁর শেকড়টিকে নামিয়ে দিতে পারেন কাহারবিহীন কল্পনাবীজ অবধি,সম্পাদনা করতে পারেন অন্তর্লীন জেগে থাকা কবিতার পরিকল্পিত সংগঠনতন্ত্র থেকে একজাতীয় উইথড্রয়াল প্রসেসে সজলকে টেনে আনে শ্রুতি । কখন যেন কবিতার রুগ্ন বাড়ি থেকে সজলকে টেনে নিয়ে এসেছিল ভিক্ষুকের আবেদনে, তাঁর পাঠ হয়ে উঠছিল স্বতন্ত্র্য তাঁর ঘরকন্না ভাঙতে থাকে,আর সমবায় থেকে সংঘের থেকে এক অদ্ভুত ঘরছাড়া সজলকে আবিষ্কার করতে থাকি-

  এভাবেই
     ঘরের মধ্যে ঘরের
              জন্ম হয়-
                    এভাবেই
                         ঘরের মধ্যে ঘরছাড়া
                                 থাকতে হয় - (ঘরছাড়া/পান্ডুর লিপি)

কবিতার চিরাচরিত অটুট ইউনিটগুলোকে সজল বন্দোপাধ্যায় উপেক্ষা করতে পেরেছেন শ্রুতি থেকেই, ক্যাটালিস্টের কাজ করেছে ষাটের শ্রুতিআন্দোলন যা তাকে চোখের বিকল্প দিয়েছে কিংবা বিকল্পের চোখ, যা দিয়ে বারবার সরে এসেছেন গোল পৃথিবী থেকে,বালি আর বুদবুদ থেকে,একটা অনিকেত স্যাংকচুয়ারী থেকে ,আসলে সজলের কাছে কবিতা ছিল একধরনের স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া , একটা বিপুল নতুনের ম্যানিফেস্টেশন;না, স্রেফ কোনো অপার্থিবের সুর নয় কোনো আঙ্গিকের অনুবাদ নয় ,সজলের সজলময়তা শব্দকে কেন্দ্র করেই শব্দের সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়াষাটের দশক যখন পরিবর্তন চাইছে আধুনিক কবিতার আধুনিক সাহিত্যের ক্লান্তিকর একঘেয়েমির থেকে,দীর্ধদিন ধরে চলে আসা প্রাতিষ্ঠানিক ভাষার মিথ ভাঙতে চাইছেন কবি লেখকরা,ঠিক তখনই প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের আধারকে আড়াআড়ি চেরাই করতে একে একে দেখা গেল হাংরী,থার্ড লিটেরেচার,শাস্ত্রবিরোধী,নিম সাহিত্য বা শ্রুতির মত ইস্তেহার ভিত্তিক আন্দোলনগুলোনিমসাহিত্য, মুচলেকা বা ইস্তেহার আন্দোলন যেখানে প্রথা থেকে প্রকারন্তরে যেতে একে একে ফ্রেমকে অস্বীকারের প্রশ্ন তুলল, যেখানে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সৃজনের স্থবিরতাকে ভেঙে ফেলতে উদ্যোগী হল ষাটের প্রায় প্রতিটা আন্দোলন,সেখানেই সজল বন্ধোপাধ্যায়, পুষ্কর দাশগুপ্ত,পরেশ মন্ডল আর মৃণাল বসু চৌধুরির যৌথ উদ্যোগে ৬৫ এ শ্রুতি ভাষাকে দিল এক নতুন মোড়, ভাষাকে মুক্তি দিল ভাষার জরুরী থেকে, ষাট দশকের সামাজিক অস্থিরতা কবিতায় না নিয়ে এসে রাজনৈতিক চেতনা বা প্রফেটিয় তত্ত্বকে শৈলী বা বাগবিধি না করে কবিতার ভাষায় প্রয়োগ হল ইঙ্গিতময় এক নতুনের ঘর,কর্ষনযোগ্য এক মোরামধ্বনিএমনকি স্বপ্ন উপকূলে এর মত কাব্যগ্রন্থ যা সত্তরের দশকের অস্থির সামাজিক সন্ধিক্ষনে রচিত সেখানেও তিনি সমাজসংস্কারকের মত আপাত সহজ উচ্চারকে ক্ষতসত্রের ম্যানিফেস্টেশন করে তোলেননি বরং নতুন সংজ্ঞা সন্ধানে ব্যর্থ বিবর্ণতাকেই ডুবিয়ে দিয়েছেন কবিতার কুয়াশায়সারারাত সারাদিন কবিতাতেই আমরা লক্ষ্য করতে পারি সত্তরের ভাষায় সজলের নিজস্ব ভৌগলিকতা
                    সন্ধ্যা
                     জানলা
                     কিংবা
                     কুকুর
                     ঘর
                     চিৎকার
                     শুকনো পেঁয়াজ
                     মুখ
                     কাশির শব্দ

                     সারারাত রাতদিন
                     সারারাত রাতদিন

                     চামড়ার গন্ধ
                     চামড়ার গন্ধ
                     চামড়ার গন্ধ

শ্রুতির মত নতুন কবিতা আন্দোলনে শব্দকে দেওয়া হল ছবিকে কথা বলানোর কাজ আর ছবিকে দেওয়া হল সংগীতের গ্র্যান্ডন্যারেটিভ যার অনুরণন থেকেই উঠে এল অধিবাস্তবের সজল বহুস্বরের সজল রাইজোম্যাটিক সজল আর এই সজল অবশ্যই শ্রুতির ফসল সজল বন্দোপাধ্যায় এবং শ্রুতি-যেন একে অপরের ধ্যান ও ধ্বনির ভেতর পাতা ওলটাচ্ছেষাটের সাহিত্য আন্দোলনগুলির অধিকাংশেরই লক্ষ ছিল স্বরলিপি ভুলতে বসা সাহিত্যের খাঁজে খাঁজে শব্দের প্রসব বেদনা ছড়িয়ে দেওয়া,শুভেচ্ছায় জ্বলে পোড়া নয় বরং প্রথাগত বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারার সবুজ কৌমার্যকে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া,আর ঠিক এখানেই সাহিত্যের জবুথবু খন্ডকালে শ্রুতি কেবল চিৎকারসমগ্র নয় শ্রুতির কবিদের লক্ষ্য বা আর্দশ কবিতাকে আঘাত করা নয় বরং কবিতাকে অব্যক্ত করা,কবিতার শরীর থেকে অসংলগ্ন করা নতুন সাংকেতিক ভাষাপরেশ মন্ডল, পুষ্কর দাশগুপ্ত বা সজল বন্দোপাধ্যায় মৃণাল বসুচৌধুরী বা অনন্ত দাশ এই পাঁচ কবিদের যে মিলিত ব্রিকোলাজ যে অচিহ্নিত নতুনের খোঁজ, যে জিজ্ঞাসা আর যুক্তির মাধ্যমে এক অপরিকল্পন খেলায় মেতে ওঠা তার প্রস্তাবনায় ছিল কালচেতনায় লুকিয়ে থাকা কবিতার নিবিড় আত্মিক তৃষ্ণাই। সেখানে কোনো সামাজিকতার প্রকাশকে বা  জৈব আর্তনাদকে তাঁরা কবিতা বলে স্বীকার করেননি, তাঁদের কবিতার মূল প্রেক্ষিতই ছিল বাস্তবতা বিরোধী ও হেরমেটিক শ্রুতির প্রথম সংকলনে পুষ্কর দাশগুপ্তের কবিতা সম্পর্কে প্রবন্ধ থেকেই শ্রুতির আদর্শ ও অভিপ্রায় স্পষ্ট হতে থাকে- জৈব আর্তনাদ কিংবা সমাজ চিন্তার স্থান যেখানেই হোক কবিতায় নয় কবিতা কবির উপলব্ধি বা আত্মিক অভিজ্ঞতার প্রকাশ এই চৈতন্যময় অভিজ্ঞতাকে গভীরতর অর্থে স্বপ্ন বলা যায় এখানে,ব্যক্তিগত উপলব্ধির আলো অন্ধকার উদ্যানে আমাদের ভালোবাসা,যন্ত্রনা,শোক,মৃত্যুচেতনা এবং বিস্ময় মিলে মিশে এক অপূর্ব রূপান্তরিত আকার লাভ করেএবং সমস্ত খন্ড অনুভব ও বাস্তব তথ্যপুঞ্জ স্বপ্নের আয়ত্তে পূর্ণতার আধারে সমাহৃত হয়; চতুর্দিকের বিচিত্র এবং অস্থির ধ্বনিসমূহ ক্রমশ এক সুরসঙ্গতিতে আশ্রয় পায় কবিতার লক্ষ্য সঙ্গতি কবিতার অন্বিষ্ঠ গভীরতর সত্য বা বোধি স্বপ্নদর্শী কবি তার সাধনায়, তার স্বপ্নে খন্ড খন্ড তথ্যের আবিলতা অতিক্রম করে সত্যকে(ট্রুথ) আবিষ্কার করে, উপলব্ধি করেএবং কবিতায় সংকেতিত হয় কবির নিহিত যাত্রার ইতিবৃত্ত শিল্পী বা কবির কাছে তার স্বপ্ন তথাকথিত বাস্তব ঘটনা বা বাস্তব সমস্যার চেয়েও সত্য(রিআল) শ্রুতি এখন ইতিহাস,তাকে নিয়ে আলোচনা গবেষনা ইতিমধ্যে হয়েও গেছে বিস্তর কিন্তু এই আন্দোলনের নাম শ্রুতি কেন সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে হয়ত আঙ্গিকগত দিক দিয়ে সজল বন্দোপাধ্যায়ের স্বতন্ত্রতা এবং কবিতার মধ্যে দিয়ে তাঁর আর্তি আকাঙ্খার মূর্হুতগুলোকে চেনা অধিকতসহজ হয়ে ওঠে শ্রুতি আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক কবি উত্তম দাশের মতে- মধূসূদনের মতো তৎসম ও যুক্তাক্ষর সমৃদ্ধ শব্দ ব্যবহারে(এই) ধ্বনি সম্পদের অন্বেষন নয়,কবিতায় ব্যবহৃত যে কোনো শব্দের মধ্যেই ধ্বনিসংগীতকে মেলে ধরার প্রবনতা থেক শ্রুতিপর্বে যে কাজটি কবিরা করতে চাইলেন সেটা হলো শব্দের চিত্রধর্মীতার সঙ্গে ধ্বনিসম্পদের সমাহার ঘটিয়ে ধ্বনির একটা চিত্ররূপ নির্মাণ করা তার মানে সহজ কথায় শব্দ মধ্যবর্তী নীরবতাকে আরও বাড়িয়ে তোলা,ছবির যে রূপ তাকে পেরিয়ে ছবির যে ধ্বনিরূপ সেই পারমার্থিকতায় পৌঁছতে চাওয়া,ঠিক এখানে এসেই আমরা যেন এক নতুন সজলকে পাচ্ছি, নীরবতার এক বাঙ্ময় সিল্যুয়েট, যেখানে গানের -সুরের-তালের গুড হেলথের কাছে ক্রমশ কুকড়ে ছোটো হয়ে যাচ্ছে শব্দের শীর্ষনাম,কবিতার ক্ষেত্রে স্পেস নিয়ে আসছে দ্বিমাত্রিকতা, করমর্দন বাড়িয়ে দিচ্ছে  ছবি গানের মত আকরহীন যোগাযোগগুলি শ্রুতি আন্দোলন তার সাময়িক পত্রিকার ১৪ টি সংখ্যার মধ্য দিয়ে  শেষ হয়ে যায়  ৭১ এ আর এই নিঃশব্দ ক্ষণিক ভাঙা আওয়াজের মধ্যেই রেখে যায় সজলের মত এক অসমাপ্ত সংগীত ,প্রলাপের বাইরে প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল, রেখে যায় জড় ব্যবস্থার সঙ্গে জীবনের যুদ্ধ,অবদমনের সঙ্গে আত্মপ্রকাশের যুদ্ধ, বদ্ধতার সঙ্গে বহমানতার , রুদ্ধতার সাথে মুক্তির সাতাত্তরে দ্বিতীয় বই স্বপ্নে উপকূলেতেই আমরা সজলের ফিউশন সলিউশনের কাছকাছি পৌঁছে যাই, কেবল নাস্তি বা রিক্ততা নয় বরং সার্বজনীন থেকে ব্যক্তিগত বা ব্যক্তিগত থেকে সার্বজনীন এমনই এক মৌলিক দ্বন্ধের কাছে ,  তবে  ১৯৬৫ তেই শ্রুতির দ্বিতীয় সংখ্যায় বয়া কবিতা থেকেই সজলের নৌকাগুলো কোয়া খুলতে খুলতে সমুদ্রের গল্প বলতে শুরু করে, এক বৃহত্তর হাঁটার তুন কেড়ে নেয় তাঁর জলভারে নত তৃষ্ণা সে সময় থেকেই সজল বন্দোপাধ্যায় যেন চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন এক অনন্য উচ্চতা থেকে জীবনকে দেখার, কবিতার সাথে ঠোকাঠুকি করেই কোথাও যেন ক্যানপির মত ছিদ্রময় পৃথিবীর ভেতর উঁকি দিচ্ছিলেন প্রাকৃত কাঠামোটি দেখার জন্য, বীজের প্রসবসমগ্রকে দেখবার জন্য। বয়া কবিতা থেকেই সজল তাঁর সময়ের থেকে আরও কিছুটা এগিয়ে উদাহর্ন হয়ে রইলেন- ভেসে গেছে বয়া এরপর থেকে ছিন্নপালের টুকরোগুলি ভেসে উঠবে মরা মাছ হয়ে ভয় দেখাবে সমস্ত মাছকে ভগ্ন পাটাতনগুলি এক একটি তরনীর মত নৌকাডুবি হবে বারবার ”……

শ্রুতির অষ্টম সংকলনে অথবা পঞ্চম সংকলনের শেষ পাতায় অস্বাক্ষরিত যে ইস্তেহার ,শ্রুতির মৌলিকতা প্রসঙ্গে যে ঘোষনাপত্র তা থেকে খুব সংক্ষেপে কবিতার চিরাচরিত মোহ ত্যাগ করার পক্ষে শ্রুতি আন্দোলনের প্রত্যয়গুলিকে সাজিয়ে নিলেই দেখা যাবে প্রথাকে বিচ্ছিন্ন করতে আতসকাচ সাজিয়েছে শ্রুতি,কোনোরকম ব্যাখা বা বিধান বা প্রচারের দায়িত্বকে কবিতার হাতে দেওয়া হয়নি দেওয়া হয়নি কোনো চিৎকার বা বিবৃতি রাজনীতি প্ররোচিত সামাজিকতা বা ক্ষুৎকাতর যৌনকাতর জৈব মত্ততার স্থান আর যেখানেই থাকুক কবিতায় রাখা হয়নি তার নটি সংখ্যায় বাংলা কবিতার পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে এই আঙ্গিকগুলিই এককথায় শ্রুতির আবহকে রচনা করে:-

ব্যবহারজীর্ণ অন্তঃসারশূণ্য ফর্মের পরিবর্তে কবিতার মুদ্রন বিন্যাসের আত্যন্তিক চর্চা

আধুনিক সাহিত্যে রং রেখা বা আলোর পরিসরই কেবল নয় তার ভেতর গীতলের অবরোহনও জরুরি 
-কোনরকম ব্যাখা, বিধান বা তত্ত্ব প্রচারের দায়িত্ব কবিতার নেই

-   চিৎকার বা বিবৃতি এর কোনোটাই কবিতা নয়

- ব্যক্তির কল্পনাময় আন্তরিক অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধির প্রকাশে ব্যক্তিত্বের পরিমন্ডল রচনাই কবিতা, তাই কবিতা হবে ব্যক্তিগত-মগ্ন এবং একান্তই অন্তর্মুখী

- এছাড়া কবিতায় কোন একমুখী বক্তব্য বা একটি মাত্র বিষয় থাকে না, থাকে বহু অনুভবের মিলনে  জটিল উপলব্ধির আবহ

বিবৃতিধর্মী জীর্ণ প্রকাশপদ্ধতি ত্যাগ করে সব সময়ই উপযুক্ত প্রকাশরীতি খুঁজতে হবে

-ছন্দ মিলের প্রয়োজনে কবিতার ভাষা নিয়ন্ত্রিত হবে না স্বরভঙ্গির স্বাভাবিক স্পন্দনের ভিত্তিতে তৈরী হবে প্রত্যেক কবির নিজস্ব ছন্দ
         
-কবিতায় থাকবে না কোনো প্রথার শাসন, ছিন্ন করতে হবে সংস্কারের সমস্ত বন্ধন

- আর চরিত্রের স্থবিরতার চেয়ে ব্যক্তিত্বের পরিবর্তনশীলতাই শ্রুতির লক্ষ্য

সমকালীনকে ভাঙতে শ্রুতির ভেতর সক্রিয়ভাবেই ছিল রেখা ও রঙের নিঃশব্দ বিপ্লব , একটা জিওমেট্রিকাল ইনটেরিয়র মডেল- পুরাতন ফ্রেমগুলোকে নতুন মুদ্রন বিন্যাসের হাতে তুলে দেওয়া, যেখানে বিশেষ ছক বা আকারে কবিতাকে বিন্যস্ত করে কবি তাঁর মানসিক অনুষঙ্গকে সংকেতিত করতে পারেন, কবিতার অর্ন্তমুখ দেহবোধকে অনুশাসিত করতে পারেন প্রুনিং পোয়েম, প্যার্টান পোয়েম অথবা ফরাসী অটোমেটিক রাইটিং-বা কংক্রিট কবিতার মত দর্শনগুলো থেকেই শ্রুতির মীড় গমক আপলেনিয়ার, কামিংস বা মার্লামেরা শব্দের সাথে ধ্বনির চিত্রময়তার যে এক্সপেরিমেন্টাল অ্যামালগেমেশন করেছিলেন, কিছুটা তার বয়নেই  কবিতাকে বাঁধা গতের ফর্মূলা থেকে  ,প্রত্যক্ষ অনুকরনের থেকে পরোক্ষ অনুরনের দিকে নিঃশব্দ ভ্রমণ দেওয়াই ছিল শ্রুতির লক্ষ। শব্দের বর্ণপরিচয়ে একটা প্রতীকভাবনা খুঁজছিল,লেখনীর মৌলতায় দৃশ্যের ন্যুড ম্যুরাল খুঁজছিল, শব্দের জল কাদা ঘেঁটে এসে খুঁজছিল একটা মহার্ঘ্য জ্যামিতিক প্যার্টান আর এখানেই ছিল শব্দমধ্যবর্তী দৃশ্যমুক্তির এক চরম প্রিয়তা খুঁজে পাওয়া, মুদ্রণলিপির তাবৎ কৌশলের মধ্যে প্রায় অজ্ঞাত একটা গীতিময়তার জন্ম দেওয়ার সুযোগ ৷কবিতায় ভিস্যুয়াল ডোমিন্যান্সিকে আশ্রয় দিতে টাইপোগ্রাফিক নির্মাণের আদি উদাহরন ১৬৩৩ এর জর্জ হার্বাটের ইস্টার উইংগস এ দেখা গেলেও ইওরোপীয় সাহিত্যে আপেলিনর বা কামিংসের কংক্রিট পোয়েট্রি  বা অলংকার বিন্যস্ত ফ্রেম পোয়েট্রিকেই শ্রুতির দৃশ্যকবিতার পথীকৃত বলা যেতে পারে ; ফরাসী কবিতার প্রতীকবাদের প্রতিধ্বনিকেই কোথাও শ্রুতির আয়না আলো ফেলে ফেলে দেখতে চেয়েছিল তার নিজস্ব আঙ্গিকে নিজস্ব উচ্চারনে আর তাই ফরাসী কবিতার নতুন মানসিকতা নতুন মাধ্যমের ব্যবহার বহুক্ষেত্রেই শ্রুতির সারাৎসারে পুনর্গঠিত হয়েছে, তার নিজস্ব নিয়মতন্ত্রের মধ্যে পরিশ্রুত হয়েছে শ্রুতির দ্বিতীয় সংকলনে অন্যতম প্রবক্তা পুষ্কর দাশগুপ্ত তাঁর কবিতার আঙ্গিক/কবিতা সম্পর্কে নিবন্ধে লিখছেন-কবিতার মুদ্রিত উপস্থাপনায় বিশেষ ধরনের দৃষ্টিগ্রাহ্যতা (visuality) সৃষ্টি জটিল আত্মিক অভিজ্ঞতার প্রকাশে কলাকৌশলের অঙ্গীভুত অন্যতম উপকরন হিসেবে প্রযুক্ত হবার উপযুক্তএ চিন্তা অভিনব কিছু নয়,তবে এ ব্যাপারে সংস্কৃত বা প্রাচীন ইউরোপীয় সাহিত্য থেকে উদাহরন অপ্রয়োজনীয়আর সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রে স্বীকৃত কবিতার চিত্রবিন্যাস বা চিত্রঅলংকার নিতান্তই বৈচিত্র্য-সম্পাদক অলংকরন হিসেবে ব্যবহৃত হত উপলব্ধির ব্যঞ্জনাময় প্রকাশের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল না বলেই তা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়আত্মস্থ কবিতার প্রকাশকলাই আমাদের প্রসঙ্গতাই আধুনিক কবিতার মুদ্রিত প্রকাশে দৃষ্টিগ্রাহ্যতা সৃষ্টি বা নতুন বিন্যাসের ব্যাপারে মালার্মে অ্যাপলিন্যার, মায়াকোভস্কি,কামিংস,অমিয় চক্রবর্তী প্রভৃতি কৃতকর্মা কবির প্রয়াস স্মরনীয়এবং মুদ্রন বিন্যাসে দৃষ্টিগ্রাহ্যতা সৃষ্টি বাংলা কবিতায় চর্চার দ্বারা জীর্ণ হয়নি বলেই তা অকর্ষিত ভূমির মতোই সম্ভাবনাপূর্ণএবং এ ধরনের নবপ্রকরনসন্ধানে পুষ্কর দাশগুপ্ত স্মরন করেছেন আর্তুর রাঁবোর সেই আশ্চর্য উক্তিও-অজ্ঞাতের আবিষ্কার নতুন ফর্মের দাবী করে শ্রুতির ইস্তেহার অনুযায়ী মুদ্রন বিন্যাসের নতুনত্বে পাঠের সময় কবিতা,পাঠকের চোখ ও কানে মিশে যায়,যে দৃশ্য তিনি কানে শুনছেন সেই দৃশ্যই চোখে দেখছেন, যা আদতে দৃশ্য ও ধ্বনি মধ্যবর্তী এক নবতর বাইনারী গড়ে তোলেমাত্রাগত কাব্যিক বর্ণনাগুলো ভেঙে বাস্তব ও অবাস্তব সীমারেখা লুপ্ত করে দেয়এই চিত্রিক বাচন আসলে এক আকৃতিপ্রাপ্ত গদ্য বা ফরাসীতে যাকে বলা হত ভের রোপালিক,সেখানে নুন্যতম রেখাচিত্রের সাহায্যে সম্ভাবনাময় দৃশ্যলিপি তৈরী করাই নব নান্দনিকতার শর্ত যদিও শ্রুতির অপর সহযোদ্ধা পুষ্কর দাশগুপ্ত পরেশ মন্ডল বা মৃণাল বসু চৌধুরীর মত দৃশ্যকবিতার নির্মান সজলের পরীক্ষানিরীক্ষায় অপেক্ষাকৃত কম লক্ষনীয় তবু কংক্রিট পোয়েট্রি বা সেপ পোয়েট্রি বা ভিস্যুয়াল পোয়েট্রিতে স্বাভাবিক সমর্থন লক্ষ্য করা যায় শ্রুতি বা তার পরবর্তী সজল বন্দোপাধ্যায়ের কিছু কবিতাতেওতবে এর বাইরেও সজলের বিশেষ ধারার কবিতাগুলোর প্রতিস্রোতে রয়ে গেছে অভ্যাসিত ছবিতা প্রকৃত অর্থে বিপ্লব বলার চেয়ে শ্রুতির ব্যকরনছিন্ন এই মুদ্রিত নির্মানগুলিকে বিবর্তনের আখ্যা দেওয়া যেতে পারে ভাষাকে বর্জনপেক্ষা বহুদিনের গড়ে ওঠা ভাষাকাঠামোকে যেন বর্জনের অঙ্গীকার সেখানে শব্দের অর্থকে ছবির ঠিকানা দেওয়ায় বা দৃশ্যের কাছে উৎসর্গীকৃত করায় বোধ কেবল বিস্ময়ে সীমাবদ্ধ রইল না বরং দৃশ্যানুষঙ্গ অবচেতনের সুরকেও দিল সচকিত বিশ্বাসের স্বর শ্রুতির লক্ষ্য- আদর্শ- অভিপ্রায়েই ছিল সোচ্চার বিবৃতিধর্মীতা বর্জন এবং শব্দের চেয়েও শব্দের প্রতিবিম্বের রূপটিকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করা অর্থাৎ শব্দ দিয়ে ছবি তৈরী আর ত্রিতালী বা কারা কথা বলতে বলতে পারার মত কবিতায়  মূলত দৃশ্যের এই অনুরনময়তাতে সজল বন্দোপাধ্যায়ও খুঁজেছেন কবিতার নতুন আয়তন নেহাত দৃশ্যপাঠ নয়,সজলের কবিতায় দৃশ্য মধ্যবর্তী নিবিড় অজ্ঞাতে কিছুটা পর্যটন রাখা যাক, দেখা যাক একটা কবিতা কিভাবে একধরনের সংহত ছবির আধেয় হয়ে উঠছে সজলের কবিতায়-

(কারা কথা বলতে বলতে/সজল বন্দোপাধ্যায়)

                             স্থি
এবং দুচোখের মধ্যে                                                চেয়ার টেবিল বই
     আমি                                                                          ঘর
                       য়ে
                     সা       শু      
         
                     রা     য়ে      বং
                       
                       দি            

                          ছি      ক্ষ
         
                         ত্র


       কা        রা       বা       সে       ট্রা     মে             থে      কা      রা
        পা        য়ে                   ব্দে           থা                তে
                           তে
                  কবরের   মধ্যে
                   না

                   ভি
                  
                   রে

পুরো কবিতাটাই একটা কৌশলের খেলা, শব্দের অনেক আগেই যেন একটা গল্প একটা চিত্রনাট্য প্রিজার্ভ করে রাখা হয়েছে একজন কবির টুপি থেকে শব্দের চোখ ধাঁধানো আলোয় বেরিয়ে আসছে একজন চিত্রশিল্পীর স্বাধীন টোপাজএকটা জড়ানো সংসার, যে বারবার চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ নিয়ে বলে চলেছে  শব্দের তো কোনো অস্তিত্ব নেই সে মৃত কেবল ধারন করে আছে দৃশ্যের কিছু গেরস্থ হেঁশেল যার মাঝে মাঝে গৈরিক বসনপরা বোধের সংসারকাহিনী ঢুকে পড়ে কবিতাকে কেবল কিছু ভিস্যুয়াল স্টোরিলাইন দিচ্ছে শব্দ তো কিছুই করে না সে কেবল ঠেলে দেয় কয়েকটা ফরমূলা ফ্রেমের দোকানপাটের দিকে ,ডায়লগ বা ধ্বনিপরিক্রমা নয় বরং গড়িয়ে দেয় কিছু কনসিকোয়েন্সেস কিছু পসিবিলিটিস কিছু অবয়বহীন আবহসংগীতের দিকে আসলে সেক্ষেত্রে শব্দের কোনো ফোকাস নেই কেবল অ্যাপ্রেশিয়েসন আছে দৃশ্যের দাদাগিরির আর ঠিক এখানে দাঁড়িয়েই সজল যেন কবিতাকে তুলে নিচ্ছেন ক্যানভাসের হাতে, ক্যামেরাকে তাক করছেন দৃশ্যের বেড়ে ওঠার দিকে, কয়েকটা গতিশীল ডায়ানামিক পয়েন্টের দিকেসমস্ত কবিতাটিতেই বক্ষবন্ধনীহীন কিছু শব্দ কিছু বাক্যের মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে অ্যানেক্সিটি অফ সেপারেশন,অথচ তারা বিচ্ছিন্ন হচ্ছে না একে অপরকে শব্দের শাসন থেকে মুক্তি দিচ্ছে ছবির একটা সামগ্রিক আকুতির দিকেএকটা ইনটার্নাল মনোলোগ বা মেনালকোলিক সেন্সের মধ্যে দিয়ে যত্ন করে বাড়িয়ে দেওয়া দৃশ্যের সুঁড়িপথ, সে পথ একটা সামগ্রিক অনুপস্থিতিকে রচনা করে হেঁটে চলেছে , সে পথের ক্লান্তি নেই, কেবল আগন্তুকের মত পাঠককে নিয়ে ,থুড়ি ,ছবির দর্শককে নিয়ে একটা সম্পূর্ণ দৃশ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে সজল বন্দোপাধ্যায়ের বিনীত অপেক্ষা; একটি কবিতাকে প্রকাশের জন্য কেবল শব্দের আর্তি নয় বরং প্রতিনিয়ত তার পুর্নবসতির খোঁজ করেছেন সজল, ব্রাশ স্টাকচার দিয়ে, তুলির অনিয়মিত টান দিয়ে একদিকে গভীরতাকে বোঝাতে ভিতরে শব্দটিতে প্রয়োগ করেছেন ভার্টিকাল স্ট্রোক ঠিক তেমনি গতিকে বোঝাতে বাসে ট্রামে পথে বাক্যকে সাজিয়েছেন সমান্তরাল অঙ্গরাগে আবার আমি এবং আমাকে ঘিরে আনুষঙ্গিক স্থবির চেয়ার-টেবিল-বই-ঘর এর মত দায়বহনকারী মিথ্যে স্থাবরগুলির মাঝে স্থির হয়ে বাক্যবন্ধটিকে ব্যবহার করেছেন পার্টিশন হিসেবে , যেন নিঃসঙ্গতার স্বনির্বাচিত একটা দেওয়াল সেখানে দাঁড়িয়েই পাঠককে চেনাচ্ছেন শূন্য থেকে শূন্য, চেনাচ্ছেন বোবা বাস্তবের শেষের সেই অন্ধ দেয়াল ভাবেই সজলের কবিতায় শব্দের বাঁধারূপ নেই বরং তার তার দেহতত্ত্বকে দৃশ্যের সজীবতা দিয়ে একটু একটু করে ভরে দিলেন এক নতুন রসপাত্রে ,যেখানে রচয়িতার ভাবনার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ছে পাঠকের উচ্চতা, আর শব্দের বোধের,চরিত্রের সাথে সাথে পাঠক মিলিয়ে নিচ্ছেন এক কল্পিত অ্যানাটমি যা এতদিনকার বাঁধা ছাঁদ দিয়ে মেলানো যাচ্ছিলনা পুরোপুরি উদয়নে বসে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ছবি জিনিসটা হচ্ছে গিয়ে একটা ফর্মের হারমনি রঙের হারমনির সমাবেশে একটা এক্সপ্রেশনকে রূপ দেওয়া তার ধারা বা বাইরের রূপ আলাদা হোক না কেন মূলত তারা একই মানুষের প্রত্যেকেরই ইনডিভিজুয়াল একটা স্বাতন্ত্র্য আছে প্রত্যেকেই আলদাভাবে দেখছি,বিভিন্নরূপে তার প্রকাশ করছিকিন্তু সেইটে বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে সেই বিভিন্ন ভঙ্গীর ভেতর দিয়ে বিভিন্ন ভাষার ভেতর দিয়ে যে আবেদন ফুটিয়ে তোলে,সেখানেই হলো সর্বজনীনতা সজল বন্দোপাধ্যায়ের দৃশ্যকবিতায় ভাষাও এভাবে এক সর্বজনীন বোধকে লোকেট করতে পারে, একটা প্রকান্ড ছবিকে এঁকে দিতে পারে কত সহজ়ে কেবল অক্ষরের সাক্ষাতকারে আঙ্গিকের সান্নিধ্যেকারা কথা বলতে বলতে কবিতাতেও শব্দের ডিসর্টশনগুলোয় যে গভীর চোরাটান তাতে  টেক্সচারের মধ্যে দিয়ে সফলভাবে দুলিয়ে দেওয়া হয়েছে দুকূলবিস্তীর্ণ একটা দিগন্তময় থাকা একইসাথে চিরদিনের একটা অনতিক্রম না থাকা একটা অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে এক টুকরো ক্যানভাসের সামনে সজল বন্দোপাধ্যায় যেন সেই রহস্যময় জাদুওয়ালা যিনি দাঁড় করিয়ে গেলেন দর্শককে, লিপি নয় বরং একটূকরো প্রতিলিপির মধ্য দিয়ে প্রতিসারিত সত্যকে দেখার জন্যকেবল আঙ্গিক বা প্যার্টানেই ভিস্যুয়াল এফেক্ট নয়, স্বপ্ন উপকূলে থেকে শুরু করে মীড়,পিকাসোর নীল  জামা বা অব্যয় গ্রন্থমালা বইয়ের ছত্রে ছত্রে রয়েছে এক্সপ্রেসিভ ল্যাঙ্গুয়েজ ,চলমান ভাষ্য,যা আসলে শব্দের দর্শনপ্রস্থান থেকে বেরিয়ে এসে চিত্রপটের সপ্রাণতা চাইছে; কবিতার বহুতর ব্যাখার বা শ্রুতিগ্রাহ্যতার পাশাপাশি কল্পিত দৃশ্যটির কায়াবাদী মুক্তিলাভও চাইছেআর এভাবেই কবিতার বাইরে সজল বন্দোপাধ্যায় মাইগ্রেট করেছেন কিছুটা গল্পের খানিকটা ছবির মনতাজেমীড় এ তিনি লিখলে-

চোখ বন্ধ করলে মুখ
চোখ বন্ধ করলেই মুখ                                     
নিঁভাজ একটি দৃশ্যমন্দির, চোখ বন্ধ করলেই যা ভেসে উঠছে
চোখ বন্ধ করলেই দুটো চোখ                             
আবার চোখ খুললেই মিলিয়ে যাচ্ছেকবিতার মধ্যে শব্দের
চোখ বন্ধ করলেই দুচোখের জল                         
মধ্যে নিরবসান এক চিরদিনের ছবি, শব্দের আড্ডা
চোখ খুললেই অন্ধ-                                        
থেকে যে তুলে নিচ্ছে গল্পের প্লটগুলো, টেনে দিচ্ছে দৃশ্যের
               দ্রাঘিমাগুলো কথনের না বলা আখ্যানগুলো
                রেখা প্রাধান্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে


                   অথবা
স্বপ্ন উপকূলে এ লিখছেন

কুঁজোর মধ্যে জল
আলনায় জামাকাপড়                                    
এক্ষেত্রে মুদ্রনবিন্যাসের সাহায্যে কবিতায় দৃষ্টিগ্রাহ্য অনুষঙ্গ
আলমারীতে বই                                         
সৃষ্টি নয় বরং দৃষ্টিগ্রাহ্য কিছু উপকরনের মাধ্যমে নির্ভার
বিছানার ওপর চাদর                                   
ছবিতার দাবী করছেন সজল ছবিকে ধরছেন শব্দের
আর……                                               
ট্রাপিজে প্রতিটা বাক্যই এখানে রাফ টেক্সচার,
                                                            
পিগমেনটেশন,ভিজে জমি বা কাদামাটি
            আর এই সমস্ত নিয়েই একটা সম্পূর্ন নকশা, সমস্ত নিয়েই 
            এক চিত্রীর আগ্রাসন
                 
                            
                         অথবা

চাঁদের ওপর
       হাত                             
অন্ধকারের ওপর                                          
ফিল্ম সিকোয়েন্সের রিকনস্ট্রাকশন
       হাত                                                  
লক্ষ্য করা যাচ্ছে এক্ষেত্রে, ভাষা বা শব্দের ইনফরমেটিভ লিমিটেশন  
                                                            
 অতিক্রম করে সম্পূর্ণ বয়ান থেকে পা ছেড়ে উঠে
যন্ত্রনার ওপর                                              
আসছে কিছু ভিস্যুয়াল কমিউনিকেশন কিছু ইমেজারী
       হাত                                                
এক্সপ্রেশনএ যেন আয়নার সামনে বসে অবয়বের
ছবির ওপর                                               
রহস্য খুঁজছেন কবি, শব্দের ভেতর ফেলে ছড়িয়ে রাখা
       হাত                                                
নিদারুন ক্ষতগুলো,আর্টিস্টিক অ্যানাটমি গুলো খুঁজছেন সজল
কারা শুধু হাত রাখছে                                

আবার পিকাসোর নীল জামা গ্রন্থের লোডশেডিংকবিতাটা লক্ষ্য করা যাক,যেখানে স্বরবর্ণের কয়েকটি চরিত্রকে দিয়ে চতুরাঙ্গিক আঁকিয়েছেন সজলযেন পৃথক পৃথক চরিত্র উঁকি দিচ্ছে বিমূর্ত অব্য়বে আর মিলে মিশে হয়ে উঠছে প্রাত্যহিক এক অসমতার ছবি,হাজারদুয়ারী গড়তে চাইছেন সজল,ল্যাংগুয়েজ অফ ওয়ার্ডকে দৃশ্যের মেটা-ল্যাংগুয়েজ বানাতে চাইছেন, হ্যাঁ ছবিই যেন তার কবিতার প্রথম ও শেষ দর্শণ ...

আ অ কে বল্ল         -   হ্যারিকেন এনো,
 ঈ ই কে বল্ল           -   কেরোসিন তেল,
  ঊ উ কে বল্ল        -     টর্চের ব্যাটারী চাই,
 --উ বল্ল           -   কিন্তু-
 মাস ফুরোতে আর কটা দিন!

শব্দ যেন সেতুর কাজ করেছে এখানে। কবিতার মধ্যবর্তী অপশনাল ছবিগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যাবে কবিতার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে জীবনের নাতিদীর্ঘ উপচিত্র। তিনি জানতেন শব্দের জগত ছোটো কিন্তু তার পেছনে লুকিয়ে থাকা ছোটো ছোটো ছবির যোগফলেই চেতনার অন্তঃস্থল অবধি একটা ভিশন পাওয়া সম্ভব। ঘর-সংসার কবিতাটিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে শুয়ে থাকাশব্দটাই যেন কবিতার সাথে স্বগত ভাষন নিয়ে কন্ঠীবদল করছে পেলব বেঁচে থাকার পরিমিতিতে আশ্রয় নিচ্ছে প্রাত্যহিক যন্ত্রনার অরূপকথা শুয়ে থাকা বাক্যটির প্রতিটা সিলেবল-এর দুপ্রান্ত জোড়া না দিয়ে এবং মাঝের ফাঁক থেকেই একজন উপবিষ্ট সাধকের মত সজল আমাদের চেনাচ্ছেন বিষয় ও বিষয়হীনের যুগপৎ টানাপোড়েনযেন এই অন্তবর্তী ফাঁকগুলিই প্রাত্যহিক ক্ষতস্থান যা ভরার নয় যা ভরাতে চান না সজলও বরং বিনির্মাণভর্তি অজস্র অনুকবিতা রেখে দিতে চান শব্দহীন ভূমায়শব্দের ধ্যানস্থ শরীরে নিরাকার শব্দের তেলরং বুলিয়েছেন সজল,আর এভাবেই বার বার কেবল কবিতার কফিহাউস নয় কেবল শব্দের লজিস্টিকস নয় বরং জরাগ্রস্ত স্নায়ুর কল্পপ্রতিমা উঠে এসেছে সজল বন্দোপাধ্যায়ের পরিশীলিত কাব্যিক প্রেজেন্টেশনে
         
আমার
সারা
রাত
সারা
দিন
       
কাচের
        
ওপর
একা
শু     য়ে     থা     কা (ঘর-সংসার/স্বপ্ন উপকূলে)

পাশাপাশি প্রুনিং পোয়েট্রিকেও ইন্ধন জুগিয়েছেন সজল বন্দোপাধ্যায়শব্দকে কেটে কেটে সংক্ষেপিত করেছেন এক নতুন জ্যামিতিক আকার দেওয়ার তাগিদে, নতুন আয়তন নতুন নির্সগের সমন্বয়-সম্ভাবনায় একটি লাইন থেকে পরের লাইনে কমিয়ে এনেছেন বাক্যের পরিসর বাড়িয়ে দিয়েছেন গূঢ়ার্থবহ ছবির বার্তা, রেখাকে দোলায়িত করেছেন রঙের পরাবাস্তবে,এ যেন এক সংযোগাত্মক মিশ্রন,বোধকে বহুমাত্রিক করতে শব্দকে কেটে কেটে দৃশ্যের কিউবিজমে পুনর্নিমানের তাগিদ,সংক্ষেপনকে সেলিব্রেট করাপিকাসোর সান্নিধ্যে এসে ঠিক এমনই এক কিউবিজমের ধারনায় কবিতার ভাষার এক বৈচিত্র্যময় পরিসর খুঁজে পেয়েছিলেন আপলেনিয়রও, যার দৃশ্যকবিতা পরবর্তীকালে শ্রুতির কাঠামো গঠনে আত্মিক ভূমিকা পালন করেজন্ম কবিতায় এই জাতীয় প্রূনিং পোয়েট্রির প্রাথমিক প্রতিমানটুকু আমরা দেখতে পারি যেখানে কবিতার কোনো অধিকার নেই বরং দৃশ্য দখল করেছে কবিতার দারুযন্ত্রপ্রতিটা বাক্য প্রতিটা পদসজ্জা তার ক্লোজিং স্টেটমেন্টে ছেড়ে যাচ্ছে একটি তরঙ্গ,শব্দের সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে গড়ে উঠছে সম্ভাবনার কবিতা

বেগুনী নীল আকাশী সবুজ হলুদ কমলা লাল
বেগুনী নীল আকাশী সবুজ হলুদ কমলা
বেগুনী নীল আকাশী সবুজ হলুদ
বেগুনী নীল আকাশী
বেগুনী নীল
বেগুনী                        (কবিতা-ন্ম )

সজল বন্দোপাধ্যায়ের কবিতায় মুদ্রননির্ভরতার কাছে এলেই বোঝা যায় তাঁর ভাবনা চিন্তার রাজত্বে অর্থের কোনো একমুখ নেই,অনুগৃহীত ভক্ত নেই ,তার শরীরে সম্ভোগতৃপ্তি নেই বরং তিনি অর্থের থেকেও বেশি ট্রিগার করছেন কবিতার আঙ্গিককে ,আঙ্গিকই হয়ে উঠছে অর্থময়তা বেগুনী দিয়ে শুরু হয়ে এই যে বেগুনী তে শেষ হল এর মধ্য দিয়ে সঙ্গীতেরই একটা সুষম ভারসাম্য লক্ষ্য করা যায়যেন এক একটি রাগ এক একটি তালকে ব্যবহার করে ছবির বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে কবিতাশ্রুতি পরর্বতী সজল  বারবার তাঁর কবিতাকে চিরাচরিত কাব্যিক কোটস থেকে বের করে এনে তার ধ্বনিসুখের কাছে যুক্তি খুঁজেছেন ,কবিতার ভাষা থেকে ঘোষিত চিরন্তনতা থেকে সংস্কারতা থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন তার হাড় পেশির কেন্দুলী নিয়েএবং সেটাই যেন তাঁর ব্যক্তিগত ট্যাবু তাঁর কথার টপোগ্রাফিশ্রুতির দৃশ্যনির্ভর কবিতা নব্যধ্রুপদিকে পূর্নজাগরনের সুযোগ করে দিল,মেধানির্ভরতা থেকে মেধার পেছনে এসে দাঁড়াল আবছায়া এক মশগুল,যেন দৃশ্যসংবেদের এক অনন্য ক্রনিকল আর সেখানেই স্বয়ম্ভরতা ধরে সজল ভেঙে চলেছেন বাংলা কবিতার সনাতনী যুথবদ্ধতা,ভেঙে চলেছেন শব্দ মধ্যর্বতী সংরক্ষনের স্থিরতাঅক্ষরের মধ্যে হৈ হৈ করছে অভিযানের মনোরমা,একটা ভরপুর ছোটাছুটির ছবিকে তাঁর চিন্তাচেতনার শরনাপন্ন করেছেন সজল তাঁর কবিতারাও হয়ে উঠেছে কিছু দৃশ্যের কিছু রেখাআকরের গ্রুপফটো

তৃষ্ণা আমার তরী থেকে শুরু করে একে একে স্বপ্নে উপকূলে, পিকাসোর নীল জামা,মীড়,ব্রায়ার পাইপ ,বা কথাবিন্দুর ন্যায় বইগুলিই প্রমাণ করে শ্রুতি আন্দোলন সজলকে কীভাবে ধীরে ধীরে ভেঙেছে,কীভাবে ডিমিথ করেছে তার ধ্বনিসরনকে তার শব্দচেতনার আঙ্গিকটিকেনা,কোনো লোগোসেন্ট্রিজম নয় বরং কবিতায় তিনি এনেছেন সংকেত, যে সংকেত পাঠককে কবিতার আবহে নিয়ে যাবে মেকিং অফ পোয়েট্রিটিকে চেনাতে,কবির ডিপারচারগুলোর সাথে ডাইলিউট হতে শিখবে পাঠক প্রুনিং পোয়েট্রি , ভিস্যুয়াল পোয়েট্রি বা কংক্রীট পোয়েট্রির মত ফরাসী ধারাগুলির যে দেশীকরন শ্রুতি  প্রয়োগ করেছিল বাংলা কবিতায় তার মাধ্যমে সজল বন্দোপাধ্যায় কোনো কবিতাবৃক্ষ গড়তে চাননি বরং সরাসরি কবিতাচারাটিকে পুঁততে চেয়েছেন এবং দেখাতে চেয়েছেন শুধুমাত্র একটা মৌলিক অবস্থিতি,শব্দমধ্যবর্তী ধ্বনির ব্যবহার তার এনার্জিসেখানে শব্দের বা সংকেতের কোনো সংগঠনের প্রস্তাবনা নেই প্রয়োজনও নেই কোনো সময়বৃত্তের,একটি বিশেষ অবস্থাকে বোঝাতে তাকে সাজানো হয়েছে বিশেষ আঙ্গিকে,সেখানে বোধি থাকতেও পারে নাও পারে ,দর্শনের পেছনে বিন্যাসের জ্যোর্তিময় জাগরনটাই সেখানে মুখ্য; শব্দমধ্যবর্তী জ্যামিতিই সেখানে ঠোক্কর খাচ্ছে অসীমে-সসীমেকবিতার সেন্টার অফ গ্র্যাভিটি হয়ে উঠছে কিছু সাংকেতিক ব্লুপ্রিন্ট যেমন তিনজনের গল্প বা জন্ম মৃত্যু এইসব বর্ণালী খেলনা কবিতার কিছু অংশ  দেখা যাক, যেখানে কোনো দীর্ঘকালীন পথ গড়তে চাননি সজল বরং প্রশ্যয় দিয়েছেন প্রতিটি স্বতন্ত্র্য সচেতন পদক্ষেপকে,জন্ম মৃত্য এইসব বর্ণালী খেলায়  এক একটি রঙ ধরে এক একটি মনস্তাত্ত্বিক দর্শনে ভ্রমন করছেন সজল আর রংগুলো এখানে রঞ্জকের কাজ করছে ,শব্দের স্বল্পায়ুর অভাব পূরণ করছে দৃশ্যান্দ্রিয়ের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তারতম্যে আর এভাবেই পাঠক প্রতিটা পার্থিব রঙের সাথে প্রতিটা অপার্থিব রুদালিকে মিলিয়ে নিয়ে গুলে যাচ্ছে কবিতার সমস্বত্ত্ব্ মৌলেপাশাপাশি তিনজনের গল্পেও একা ছেড়ে রাখা হয়েছে কতকগুলো স্টেটমেন্ট,পাঠককে বসিয়ে রাখা হয়েছে একটার পর একটা দৃশ্যের সামনে ,অক্ষম শব্দকে নিয়ে খেলছে সে পাক্কা ইম্প্রেশনিস্টের ন্যায় আর ক্যানভাসের অনেকটা জুড়ে ফুটিয়ে তুলছে শব্দের প্রতিফলনযোগ্যতাকে :- 





সজল বন্দোপাধ্যায়ের কবিতায় দর্শণের ভাঁড়ার যতটা তার চেয়েও বেশি যেন আনন্দ আস্তিক্য; আত্মনির্মিত কবিতারা তাই কখনও সখনও তালিম নিয়েছে সজলেরই একান্ত গানের পরিবেশ, গানের আবহের কাছেশব্দের কাছে কোমল ধৈবতের মীড় টেনেছেন সজল,ভাষার গঠন গায়নের এক গভীরতম গবেষনায় টেনে নিয়ে গেছেন পাঠকের পাহাড়ীকে শ্রুতির অঙ্গীকারেও কবিতায় গানের আচ্ছন্ন আলাপ থাকার প্রসঙ্গ থাকলেও সম্ভবত সজল বন্দোপাধ্যায়ই একমাত্র শ্রুতিশরিক যিনি তা সঠিক অর্থে ব্যবহার করেছেনশ্রুতি প্রকল্পেই ছিল গানের কাছে কিছু কথার বাকি থাকার কথা,অন্তর্লীন লিরিকের সারল্যের কথা যেমন মিড় কাব্যগ্রন্থের ২০ নম্বর কবিতাটা দেখা যাক- সারাদিন/এস্রাজ বাঁধা/ সারারাত/ তার ছিঁড়ে ফেলা---অথবা ২১ নম্বর কবিতাটি-শব্দ/দরজায় ছুটে যাই/শব্দ/ঘরে ফিরে আসি কিমবা-জানলা আছে/তাহলে ঘরও আছে/মানুষও আছে/ জানলায় পর্দা আছে-/দুঃখও আছে-/জানলা দিয়ে হাওয়া আসছে/সুখও আছে- সজল কি লিখতে চাইলেন ধ্রুপদ ধামারের ধৈবত? তিনি নিজেও তো একজন গুনী সঙ্গীতজ্ঞ , উদাত্ত গলার অধিকারীতবে কি সুরেলা কসবী লয়দার গায়কের মত গাইতে চাইলেন চার তুকের সংগীত ? নাকি কেবল সুরে আর বাজনাতেই মাত করে দিলেন স্বর তুলতে আসা শব্দদের! আসলে সজলের ঘরানায় তালিম দেওয়ার অভ্যেস নেই কেবল তাল কাটার মজলিসি মেজাজ আছেতিনি যেন সহসার ছন্দ থেকে সামান্য শ্রুতিকে টেনে আনছেন অথচ তার স্বরসমন্বয়ে তার বাহাদুরি আর দেশীতে রেখে আসছেন একটা বিলাবল আবহন একটা প্রবাবিলিটি,একটা অনর্জিত গোপন ছবি- গোপন রঙের ভাষা, যা একটি মূর্হুতকে নিয়ে চলেছে দ্বিতীয় অগ্রসরের দিকে দ্বিতীয় অবসরের দিকে আর এখানেই যেন তাঁর দৃশ্যজগত নীরব মূল্যায়ন চেয়ে  পূনঃনির্মানের হয়ে আছে,আরও একটা স্পেস আরও স্বতঃস্ফূর্ত মিতায়তন ছেড়ে রেখেছেন ইনার পয়েন্টের ভ্রমনহেতু ,বোধিপথের গান হেতুপাঠকের জন্য রেখে দিচ্ছেন একটা এনকাউন্টারকে একটা অ্যান্টি রিপ্রেজেন্টেশনকে, রেখে দিচ্ছেন একটা কনশাস কোয়ান্টাম লিপ তিনি যে ক্রমাগত ভাঙতে চেয়েছেন একটি পরিবেশন থেকে আরও একটি অচিন্ত্য অন্যনিরপেক্ষ পরিবেশনের দিকেকোনো হারমোনিক্স বা সিমফোনি নয় কেবল সোলো ভয়েস খুঁজে চলেছেন সজল, কেবল একটা স্বতন্ত্র বন্দিশতাঁর নিজের কথায়- গানের সাথে কবিতার কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না তবে ভেতরে গান কাজ করে এটা ঠিকই গানের পরিবেশ, গানের আবহ এসব কবিতার মধ্যে কাজ করে চলেছে দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে শিখেছিলেন রবীন্দ্রসংগীত, সাথে টপ্পার অনুরাগীপ্রতীক নয়,বরং তাঁর কবিতায় মাঝে মাঝেই পাওয়া যাবে সংগীতের মতই এক ইন্দ্রিয় পরিক্রমাশব্দের মাঝে এক রিদিমিক ইন্টেলিজেন্সি,সেখানে কোনো সচকিত উচ্চারন নেই,কবিতার শব্দ নেই,কেবল চেতনাকে ব্যক্ত করার এক সরল সংযোজন,কিছু লয়বদ্ধ বন্দেশী কিছু চোরাগোপ্তা গমক, আসলে ভাষার মধ্য দিয়ে কোথাও নীরবতাতে আশ্রয় চেয়েছেন সজল,কোনো বাহ্যিক মেঘনিবেশ নয় বরং ভেতরবাড়ির অভিমানী মায়াজগতের মুখোমুখি হতে চেয়েছেন,আর সেখানে গান কখনই তাঁর পাশের বাড়ির বিস্মরন হয়ে ওঠেনি কারন সে যে তাঁর নিজের বাড়িতেই ছিল অপ্রস্তুত উন্মীলন হয়ে ,স্বনির্ভর বেজে ওঠা নিয়েকথাবিন্দুতে আমরা দেখতে পাই- হাওয়ার নাম প্রতারনা/আকাশের নাম বিষ/মাটির নাম সমাধি/আমাদের নাম ফসিল বা অন্যের কাছে গেছি/আর ফিরে এসেছি/এবার /নিজের কাছে ফিরে যচ্ছি জাতীয় কবিতাগুলিতে কোথাও সহজিয়া রাগতরংগিনী রয়েছে রূপের মাঝে অতিপ্রকট হয়ে রয়েছে অরূপাত্মক ব্যাকুলতাকোনো লঘুসংগীত নয় বরং সাধনঘরের সুরই যেন সাজানো এই জাতীয় নিজের কাছে ফেরার নির্দেশিকায়গান ও কবিতা-সজলের পথের শুরু কোথায়,কোথায় বাজে মস্ত বড় একটা সজল-এর সার্থক ব্যাখা বোধহয় কবি ও বন্ধু,অব্যয়পত্রিকার সম্পাদক অতীন্দ্রিয় পাঠকের কথাতেই নতুন পর্যবেক্ষন দাবী করে-সজলের সাথে দীর্ঘদিন মেলামেশার পর আজও নিশ্চিত হতে পারিনি,গান ও কবিতা,কোনটি তাঁর জীবনের মূল অবলম্বনকখনো মনে হয়েছে,ক্ষেত্রদুটি সমান্তরালকখনো মনে হয়েছে পরিপূরকযদিও কোনোটিই কারো থেকে ন্যুন নয়কবিতার আসরে তাঁর উদ্দীপ্ত গান শোনার পর কবিতা পাঠও বজায় রেখেছে একই উদ্দীপনা,অবসিত মনে হয় নি,অথচ শিল্প বোদ্ধাদের বলতে শুনেছি নাচের পর নাটক জমে না,নাটকের পর গান ম্লান হয়ে যায়,গানের পর কবিতা শোনা তো একেবারেই অচল কিন্তু সজলই সম্ভবত একমাত্র শিল্পী,যে দুটো ক্ষেত্রকে একই মায়ায় বাঁধতে পারেনএকারনেই গান ও কবিতা সজলের জীবনে একে অন্যের পরিপূরক শ্রুতি পরবর্তী সজলকে আমরা এভাবেই শব্দের প্রান্তে দাঁড়িয়ে দু হাতে তুলে নিতে দেখি রং ও সংগীতের অখন্ড সমগ্রতাকেতাঁর মৌলিক মুন্সিয়ানায় শিল্পের এক বহুস্ত্রবিন্যস্ত যোগাযোগ, সম্পূর্ন মহাকালমন্থনের জন্য তিনি একটাই মুখ সকলের মুখ হিসেবে দেখছেন,সেখানে শিল্পের কোনো হেমিস্ফেরিক বিভাজন নেই ,সন্তুরের আলাপে এস্রাজের ধুনে রঙের গথিকে কেবল  মুক্তির উল্লাস,কোনো ধ্যানের ভান করে সে বসে নেই বরং চেতনাকে জাগাতে এসেছে আর জাগিয়েই  সে ফিরে যাচ্ছে আর পাঠক বহন করে চলেছে এক ক্রমজায়মান নৈবদ্য যা আলোর ভেতর ছায়ার ধারনা তৈরী করছে,রূপের ভেতর এক পরম রূপান্তর
শব্দ নিয়ে কোনো বিশেষ জাগলারী না করে আনকনসাস অফ টেক্সটকে পাঠের মুগ্ধ লালন দিয়েছেন সজল,, পিঞ্জর থেকে উড়িয়ে দিয়েছেন ধ্বনির প্রতীতীসমূহ,কবিতার ফর্মকে পরিসরকে ছোট করে বাড়িয়ে দিয়েছেন মধ্যবর্তী কথার ফলনঝুমকোগতি বাদ দিয়ে চেয়েছেন স্থিতিএই স্বল্প উচ্চারন আদতে শ্রুতিরই কার্যসাধিকা,শ্রুতিরই আড়চাহনি আর শব্দের নয় বরং শব্দাশ্রিত যে আধানহীন ভরহীন মননশীল ধ্বনিকনা তারই খাদের ষড়জ তারই সপ্তকে গড়ে ওঠা সজলের কবিতাশ্রম সংহত কবিতার এই অন্বেষন কিংবা মেদহীন অনুকবিতা শ্রুতির এক বিশিষ্ট লক্ষণ এক বিবর্তিত গবেষনা কেবল আঙ্গিকের পরিবর্তন নয়, শ্রুতির ইস্তেহারেই ছিল ব্যবহারের জীর্ণতা ও প্রকাশের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম, সেখানে অন্তর্মুখী উচ্চারনই টেকনিক বা স্টাইলপেক্ষা ভেতরের কথা হয়ে ওঠে,কবি সেখানে সম্ভবের নিটোল বিরোধিতা চেয়ে সম্ভাবনার কথা বলেনঅসমাপিকা ক্রিয়ার উপর বাক্যকে ছেড়ে একটা অন্তর্লোক একটা বহির্গৃহ ছেড়ে রাখা হয় পাঠকের পারসেপশনের দিকে  অথবা বলা যেতে পারে কবি নিজেও তার কবিতার এলিমেন্টগুলোর সাম-আপ চাননাপরিনতি চাননা বোধহীন কলেবরে এ এক এমন জগত যা পরিচিত যাপনের দিকে অমনোযোগ ছড়িয়ে রেখেছে, ছড়িয়ে রেখেছে আলিঙ্গনের দ্বিতীয়তাকবিতার ইহজাগতিক সংস্রবের বাইরে দরজা খুঁজে বেড়াচ্ছে যে আত্মনির্মাণের জুঁইলতা তা তাঁর ব্যক্তিগত প্রবন্ধেই সজল বন্দোপাধ্যায় স্বীকার করছেন-দেহের স্থুল চাহিদা,উত্তেজনা এ সব পেরিয়ে আমার মধ্যে উপলব্ধির যে জগত তা নিতান্তই আমার, তাই আমার কবিতার জগতএর যুক্তি, এর অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা কোন কিছুই বুদ্ধিনির্ভর নয়, সম্পূর্ণই উপলব্ধি নির্ভর বাইরের সব কিছুই নিয়ে যে আমি অথচ সব কিছুকেই রূপান্তরিত করেছি যে আমি, করেছি আমার, এ সেই আমার জগত বুদ্ধির স্পষ্ট সিঁড়ি দিয়ে এখানে যাওয়া যায় না,উপলব্ধির রহস্যময় পথ দিয়ে এখানে মগ্ন হয়ে এগিয়ে যেতে হয়  একটা ধূসর সংগীত বা chanson grise ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছেন সজল তাঁর প্রতিটি অবিনির্মানের অনুরোধে,শেকড়ের টান দিয়েও সংক্ষিপ্ত করে ফেলেছেন প্রথাগত কবিতার ঘরানাকেএ যেন যুক্তি নির্ভরতার বর্জন,প্রতিটা শব্দকে বাক্যের বা পদের অংশ না ভেবে প্রতিটা শব্দকে একক শব্দের গুরুত্বে ব্যবহার করাঅনুকবিতার প্রতি সজল বন্দোপাধ্যায়ের বিশ্বাস ও নৈপুন্য দুই-ই লক্ষ্য করার বিষয়,বিবৃতিধর্মী কবিতা থেকে বেরিয়ে জলীয়তাহীন ভাষার ঋন শোধ করতে  ১৯৮১ তে রচিত পঞ্চান্নটি নামহীন অনুকবিতা নিয়ে মীড় অথবা কথাবিন্দুর প্রায় প্রতিটা কবিতাই পরিশ্রুত মেধাকে প্রমাণ করে,বিনীতভাবে মুখোমুখি বসায় বৈশ্বিক শূন্যতাকে ,সত্যি বলতে কি এই মৌলিক সামান্যেই তো কবির পাকানো আলোকপিন্ড তার ভেতরই তো মুগ্ধতার ছায়া দুলছেসৃষ্টিবীজকে বিশ্বপরিকল্পনার মাঝে ছড়িয়ে না দিয়ে যুক্তি ও চেতনের বুনোটে বাঁধতে চেয়েছেন সজল আর এ জাতীয় সারসংক্ষেপের মাঝে সমর্থনের মাঝে যে মানুষটি ফুটে উঠেছে সেও যেন চিরপ্রবাহিতের মাঝে স্থির প্রসন্ন, সেও যেন কনসেন্ট্রেটেড,যাবতীয় তরলতর প্রয়াস তার কাছে মাথা নত করে এসেছে কেন্দ্রের ঠিকানা চেয়েগভীর সুযুপ্তির ভেতর সে কেবল এক আঁজলার জন্য বসে আছেন বসে আছেন কিছু পোয়েটিক কনজেকচারস নিয়ে আর সেখান থেকেই একান্ত নিজস্ব ভাণ্ডার খুলে দেখাচ্ছেন বড় মাপের অবচেতনাবোধি,দেখাচ্ছেন অন্বেষনের ঐশ্বর্য্য ,আসলে কবিতার ভেতর হাত বুলিয়ে বুলিয়ে তিনি খুঁজে চলেছেন সেই মিতভাষনের মূল কবিতাটিকে যা তাকে কাউন্টার করছে কবিতার কনটেন্ট মালটিচিউডে যেতে আবার ফিরেও আসছেন অপ্রমানকে ইস্তেহার করে হয়ত এখানে দাঁড়িয়েই সজল লিখলেন 
 বেঁচে থাকতেই হবে/যতদিন না সেই কবিতাটি/লেখা হয়ে ওঠে /
কোন কবিতা? যে কবিতার জন্য তিনি ফিরে ফিরে আসছেন বিস্ময় থেকে বিস্ময়ে,পাঠককে ছেড়ে আসছেন একটা আন-ইক্যুয়ালিটির কাছে,একটা ভরাট ভয়েডের কাছেশ্রুতি কবিতা প্রসঙ্গে সজল বন্দোপাধ্যায়কে বলতে শোনা যায়-পিকাসোর নির্জনতার মধ্যে শ্রুতির মেজাজ আমার এসে গেছিল ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় কেবল পিকাসোর নির্জনতা গ্রন্থের মধ্যে দিয়েই নয় বরং সার্বিক নির্জনতার ইকোই সজলের হাতে তুলে দেয় অনন্ত পরিব্রাজকের হলুদ খাতা,যেখানে কবি সত্যি সত্যিই ভাষাশিল্পীপেক্ষা এক নিষ্ঠাবান ভ্রামনিক,শব্দের ভাস্কর্য্যগুলো যার কাছে কেবল ঘনখোদাইয়ের,গুঁড়ো করেও দেখতে চান গুঁড়োর জ্যামিতিঅক্ষরের অ্যানথ্রোপলিজর কাছে বারবার অবলোকন সৃষ্টি করেছেন সজল আর বারবার পরিনত বেড়াগুলো পেরোতে খুঁজেছেন দুটো সম্ভাবনার চোখ দুটো সম্ভাব্য হাত-
      কান্নার জন্য দুটো চোখ চাই,
             যা অন্ধ হয়ে আসছে
             লেখার জন্য একটা হাত চাই,
              যা অবশ হয়ে আসছে

অথবা শব্দকে অনুসরন না করে শব্দের রহস্যকে অবলম্বন করেছেন সাধকের নিষ্ঠায়,দ্রষ্টার অবস্থান তাঁর জানা নেই অথচ দ্রষ্টার অভিমুখে বসে আছেন তিনি, আমন্ত্রন জানাচ্ছেন চলমান অরূপকে,প্রতিমূর্হতের অপেক্ষাকে কত বড় সে অরূপ! কত বড় সে অস্থির! যেখান থেকে এক অলংকারহীন কবি নিজেকে ভেঙে নিচ্ছেন অনুরূপ প্রিজমে,খুঁজে ফিরছেন সেই বিক্ষিপ্ত আলো আর অন্তহীন জ্বালাকেধোঁওয়ার ভেতর বেঁচে থাকতে থাকতে মুঠি বাড়াচ্ছেন ধোঁওয়ারই দিকে ,এক তুমুল ধ্বনিরনন শব্দরননের মাঝে লিখে চলেছেন-

       কোনো ডাক কানে আসছে না
                 অথচ কান পেতে আছি

লিখে চলেছেন-    

       বরফের পাশে পাত্র ধরে
                গ্রীষ্মের জন্য ঠায় অপেক্ষা করছি

মনের উৎপাদন থেকে মহাজাগতিকে যাওয়ার এক চরম অপেক্ষার কাহিনী সজলের ,সজলের থেকেও কোন এক উঁচু তাকে সজল সাজিয়ে রেখেছেন তাঁর এই চিরহরিত পসার,আর দাঁড়ানএখুনি আসছি বলেই পাঠককে নিয়ে চলেছেন এক উদ্বায়ী খোঁজের দিকেকবিতার চিরন্তন সিদ্ধিবাসে দাঁড়িয়ে বারবার বাড়ি ভুল করছে সজল,বারবার ভেতরবাড়ি থেকে ম্যাজিক আয়নাদের সাথে কথপোকথনে উঠে আসছে বিন্যাস ও সমবায় ভাঙার কিছু নশ্বর প্রশ্ন-বারবার পাঠককে পূর্ণাঙ্গ সংঘের সামনে দাঁড় করিয়েও সজল চলেছেন এক অপ্রতক্ষ্য মিউটেশনের খোঁজে

    কোথায় যাচ্ছ ? খুঁজতে? কিছুতো  হারায়নি? কাউকে  খুঁজতে?
              উত্তর দিলুম না শুধু বললুম, এক্ষুনি আসছি

বেল বাজিয়ে ঢুকে পড়া যাক সজলের আরও কিছু ছবির বাড়িতে কান পেতে শোনা যাক একজন কবির বিশুদ্ধ রহস্যালোক, সংগ্রহ করা যাক সেই নিজস্বদ্রব্যগুলো যা অভাবিত যা আকস্মিক, এই সব আঁধারঘন টেক্সট মিলিয়ে মিলিয়ে দেখলেই আমরা পেয়ে যাব একজন নিবেদিত কবির মায়াবী নার্সিসাসশ্রুতির ঘোষনাগুলির কোন পৃথক চিহ্নায়ন নয় বরং তাঁর কবিতায় প্রায়সই ফুটে ওঠে একটা সার্বিক গ্রাফিত্তি,একটা বহুররর্ণিক সিমেট্রিসুর সঙ্গীত সাজের মহাসঙ্গতিবৃহৎঅর্থে ভিন্নধর্মী হতে সজল নিজের সাথেই নিজের আড্ডা জমিয়েছেন,নিজেরই প্রচল চেহারা ভেঙে গড়ে তুলেছেন অনুবিবৃতি,প্রমান করেছেন পাহাড়ের মত জমা হয়ে আছে যে অনুভব তার ডানাগুলো আসলে ছুপারুস্তম,তাদেরকে পাঁচ পৃষ্ঠায় ধরা যাবে না,থ্রি এক্স জুমে ধরা যাবে না বরং এই শ্রীউজ্জ্বল চেতনাকে কেনা যাবে নৈঃশব্দের নৈবদ্যেপ্রশ্নকে অতিক্রম করতে প্রতিপ্রশ্ন করেছেন,সত্তার অতীত হতে আত্মস্থ হয়েছেন সত্তার সৌকর্যেকিছু অযত্নকেই অসামান্য করে তুলেছেন কবিতার স্তব্ধতায় কবিতার গুঞ্জনায় ,রক্তপাতহীন শব্দের অভিঘাতে -

-     ছায়াটা বাড়তে বাড়তে
        ঘর থেকে বাইরে
        ছায়াটা ভাবতে ভাবতে
         ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
         অন্ধকার নামতে নামতে

          আর ছায়া নেই
          দেখার কিছু নেই
       

-     নিঃশ্বাস মানেই দৈর্ঘ্যের
             জল মানেই চোখের
             আজ মানেই গতকালের জের
             মুখ মানেই ছবির

            ফিরে যেতে চাইলে
            এ তো হবেই

     এভাবেই
      ঘরের মধ্যে ঘরের
            জন্ম হয়
            এভাবেই
            ঘরের মধ্যে ঘরছাড়া
            থাকতে হয়

এভাবেই অনুকবিতার সজল সেই গাছ যে শেকড় বসাতে চায়না,গয়না পড়তে চায়না,তার কোনো সঞ্চয় নেই আয়োজন নেই, সে  ছায়া দিতে জানে না শুধু পাতা ঝরাতে জানে আর পাতা ঝরানোর মাঝেই উড়িয়ে দেয় সেই সঞ্জীবনী যা সারাজীবনের ষড়যন্ত্রটুকু নিয়ে সারাজীবনের সাজটুকু নিয়ে পাঠকের পরিশ্রম চাইছে তাঁর অনায়াস স্বল্প দৈর্ঘ্যের কবিতালিপিকগুলি বয়ে বেড়ায় একজাতীয় কন্সপিরেসি অফ সাইলেন্স,সেখানে শব্দের মধুচাকে ঠোকর মারছে স্বপ্নচক্র, মেদহীন অনুকবিতাগুলির মাঝেই সজল বন্দোপাধ্যায় লুকিয়ে রাখছেন সেই সহজ এলিভেশন যা ব্রহ্মবিন্দুর দিকে ডেকে নেবে গ্রহপোকাদের,আভাসমাত্রের মাঝেই খুঁজ়েনেবে সম্পূর্ণ আধারটিকেস্বল্পদৈর্ঘ্যের শব্দগুলো জীবিত এবং ভীষনভাবে জীবিত,এবং তারা জীবিত কোনো অতিরিক্ততাকে তর্জমার জন্য নয় বরং রিক্ততাকে এক সম্পূর্নতার  আদল দেওয়ার তাগিদে তারা আস্তে আস্তে কথা বলছে বাড়ির ছাদগুলোর পাখির খাঁচাগুলোর আর দেওয়ালের ধাক্কাগুলোর সাথে,একটি মাত্র ফ্রেমে -ফরমালিনে  চুবিয়ে রাখছে একাধিক ফরমূলা,শব্দের সাথে শব্দের যা এক নিগূঢ় যোগসূত্র,শব্দের সাথে নিঃশব্দের যা একান্ত যাপন তাকেই তাঁর প্রেজেন্ট কন্টিন্যুয়াস করতে চেয়েছেন সজল কবিতার ভাষাকে মূর্ত প্রতক্ষ্য ভাষা মেনে নিয়েও ভাষার মধ্যে কোনো সযত্ন পৃথিবী নয় বরং পোড়ো বন করে সজল বন্দোপাধ্যায় ছড়িয়ে দিয়েছেন একটা মেটা-ল্যাংগুয়েজ, একটা মূর্চ্ছনা, একটা মানসিক উত্তেজনা যা তাঁর কয়েকলাইনের কবিতাকে করে তুলেছে বোধসমগ্র,প্যার্টান এনার্জিকে ভেঙ্গে চুরে সীমার মাঝে ছিটিয়ে দিয়েছে অনন্ত স্পেকুলেশন,পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছে পরিচর্চার কুহক শৈল্পিক মিতব্যয়িতা প্রসঙ্গে এজরা পাউন্ড বলছেন –“The serious artist is scientific in that he presents the image of his desire, of his hate,of his indifference as precisely that, as precisely the image of his own desire,hate or indifference. The more precise his record the more lasting and unassailable his world of art” কবিতার তরল আবেগকে তঞ্চক বেড়ি না পড়িয়েও আদ্র অবলোকনের বোধকে অন্বিত করলেন সজল ,সংযোগসূত্রটি ধরতে চাইলেন কেবল বুদ্ধিমত্তা দিয়ে  নয় বরং ধীমত্তা দিয়েও কবিতার ভাষায় বা আঙ্গিকে অভিনবত্ব আনতে যে অনুকবিতা বা মেদবিবর্জিত কবিতাকে শ্রুতি তার ইস্তেহারের  অন্যতম গনতান্ত্রিক সংযোজন করেছিল তাকেই কেন্দ্র করে পান্থজনের সখ্য খুঁজলেন সজল,তারই নান্দনিক আদর্শের কাছে এসে নিজস্ব এক দ্যোতনাময় কুলুঙ্গী তৈরী করে নিলেন অচিরেই ,তৈরী করে নিলেন সৃজনশীলতার নিজ ভিটেমাটি ,নতুন ডিকশন সে অর্থে শ্রুতির মূল সদস্যদের মধ্যে সজল বন্দোপাধ্যায়ই বোধহয় তাঁর দীর্ঘ কবিতা জীবনে শ্রুতি আন্দোলনের ভাবনা পরিসরগুলোর কেবল যথাযথ প্রয়োগই করেননি বরং শ্রুতির পরিমিত উচ্চারনে  গলিয়ে দিয়েছেন তাঁর ব্যক্তিগত শরিকিভাগ তাঁর বিশেষ জাগরন এবং এভাবে এক দীর্ঘজীবি ভাষাবদলের রূপটানে রয়েছে দীর্ঘকালীন এক বিপ্রতীপ কবিতাচর্চাওঅনুকবিতা থেকে সজল বন্দোপাধ্যায়ের স্বভাবঋদ্ধ অন্তর্জগতের পরিচর্চার বিষয়টিই উঠে আসে, কোনো গিমিক বা স্টান্ট নয় বরং অনুকবিতার টুকরো ছবিতে ভেসে ওঠে সজলের ভাবনা সূত্রের এনলাইটেড ইলোকিউশনগুলোই,অস্বীকার করার উপায় থাকে না শব্দের এই রিফিউজি গলিতেই ঢুকে পড়ে সজল নামের কোনো অভিযাত্রী তাঁর  ইলাস্ট্রেশনগুলো নিয়ে কালটিভেশনগুলোকে নিয়ে আর বোধসঞ্চয় উপুড় করেন কেবল মাত্র এক মহৎ শূন্যতার দিকে

ফুল অফ সাউন্ড থেকে সামথিংগ ইনঅডিবল-সজল বন্দোপাধ্যায়ের অনুছত্র গুলোর গায়ে লেগে আছে এমনই কিছু সাপলিমেন্টারি স্পেসের ট্রান্সডেন্টাল গ্রাফটিং ,এমনই কিছু নতুন পরিকল্পনা যা সাদামাটা ছোটছোট শব্দের পাথরে বাঁধানো কিংবা মিনিং থেকে চলেছে মিনিয়েচারে, শ্রবনঘনের দিকে,অনুকবিতা না বলে আমরা একে সরল কবিতা বলব, নাড়াচাড়া করতে ভালোবাসব কিন্তু এর নাভিমূলে থাকবে একটা কন্টিন্যুয়াস ডকুমেন্টারি একটা অলিখিত মেঘের পরিমান যা হাওয়া এলেও নড়বে না দুলবে না কেবল  নীচু হয়ে গ্রহদের হাত থেকে নেমে যাবে নিভৃত অপ্রকাশিত হয়ে  আর এই অপ্রকাশিতই এই ভয়ঙ্কর নীরবতাই সজলের পাগমার্ক সেখানে কিছু তামাকের কুচি রইল, কিছু চুরুটের গন্ধ রইল ,কিছু এস্রাজ বাঁধা রইল সারারাত আর! আর! এই আর, এই আদার ভয়েস এই অপর স্বরকেই অনুসরন করে চলল সজলের মুদ্রিত অক্ষরগুলোকয়েকটা অনুছত্রকে চয়ন করা যাক,কিছু মিতভাষন থেকে খোঁজা যাক চশমা, ফ্রেঞ্চকাট, মুখে জ্বলন্ত পাইপ আর কাঁচাপাকা দাড়ির সজলের বাইরের এক দ্বিতীয় নির্মান এক বিদেহচেতনা-

- আমি গান গাই
   আমি নেশায় ডুবি
   আমি অভিমান করি
   আমি লুকিয়ে চোখ ধুয়ে ফেলি

- কলম রইল,খাতা রইল
   বারান্দা থেকে শোনা যাবে
   পুরোনো কাগজ, পুরোনো কাগজ

-খুঁজে বের করতেই হবে
   কোথায় সেই গীর্জাটি
   যার ঘন্টার শব্দ প্রতি মূর্হুতে শুনতে পাই
   সবাই ঘুমিয়ে পড়লে

- সমস্ত বারান্দায় ছায়া-
   থার্মোমিটার ভেঙে গেল-
   জানুয়ারী থেকে  ডিসেম্বর-
   ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারী

- আমার জামার বোতামটা-
    সেই ছোট্ট বোতামটা-
    সেলাই করে হারিয়ে যাওয়া সাদা বোতামটা-

- কেউ বারান্দায় আলো জ্বেলে
    ব্লাউজের ছিঁড়ে যাওয়া বোতামটা খুঁজছে
    আর আমরা হঁটছি
    হাঁটতে হাঁটতে ভোর হচ্ছে –“

-   চাঁদের ওপর
          হাত
     অন্ধকারের ওপর
          হাত
     যন্ত্রনার ওপর
          হাত
     ছবির ওপর
          হাত
     কারা শুধু হাত রাখছে


কবিতাগুলোর প্রতিটাতেই লক্ষ্য করা যাবে কিছু শব্ধহীন ভাষাকে মূল ভাষার মাঝে মরফিয়া দিয়ে ঝাঁকিয়ে রেখেছেন সজল আর পাঠককে দায়িত্ব দিয়েছেন আত্মখননের ফোনেটিক্সটিকে খুঁজে বের করতে; তাঁর শব্দরা চুরমার করে ভাঙেনি পরিত্রাহী করে চিৎকার করেনি অথচ পরিচিত আটপৌরের বাইরেও রেখেছে একটা অধরা অষ্টাদশীকেতার অভাবই একটা থাকার ভেতর না থাকাএই অভাবকেই যেন বলছেন সঙ্গে থাকো সারাক্ষন,সেটেল্ড সায়েন্স হয়ে নয় বরং নির্দোষ জানলায় বসে থাকো নির্বোধ যন্ত্রনা হয়েএকটা অনন্য উচ্চতা থেকে জীবনকে দেখছেন সজল ৬ নং কবিতায় আলো জ্বেলে ওই যে বোতাম খোঁজা সে তো আসলে একটা ইটারনাল সাফারিংস ,কিংবা ৭ নং কবিতায় এই যে হাত রাখা সেওতো এক নিঃস্ব মানচিত্র দখলের অ্যাডভেঞ্চার যেখানে ধূলোয় মুখ চেনা যায়না যেখানে বৃষ্টি এক আধবার এসেছিলএকটা ইনএক্সজসটেবল হ্যাপিনেস যা পাওয়া সম্ভব নয় অথচ যা পেতে  কবি বারবার আঁকছেন রূপকথার প্রচ্ছদ,পুরোনো শরীরটাকে সেঁক দেবার জন্য পাইপের মধ্যে জ্বালাচ্ছে নতুন দেশলাই, ধোঁওয়ার কুন্ডলী থেকে খুঁজছে আরও এক নিরুদ্দিষ্ট মানুষ-সেই কবি সেই পাঠক সেই এই গোল পৃথিবীর ওপর অস্তি অনুসন্ধিৎসু নিয়ে গড়ে চলেছে আকাঙ্খা শরীর ,মিথ্যে যাপনের গায়েই লেপেটে দিচ্ছে একটা কনসোলেশন একটা ওয়ার্ল্ড অফ ইউটোপিয়া ওই যে আমরা হাঁটছি আর হাঁটতে হাঁটতে ভোর হচ্ছে,সে তো আসলে একটা অবিনশ্বর জাগরন,শূন্যতাকে চালান করবার খেলাআসলে ফাঁকটুকুর কথা বলতে চেয়েহেন সজলশব্দের ভেতরের সময়কে ব্যবহার করতে চেয়েছেন আঁকতে চেয়েছেন দৃশ্যকে; ছোটো ছোটো এমব্রায়ো শব্দে তো ভীষন তেষ্টা,শেকল গলে গিয়েও সেখানে মুক্তি নেই আর এই অনুপমা অনু কবিতার আদলেই সজল ধরতে চেয়েছেন শব্দমধ্যবর্তী গর্ভপাতের সম্পূর্ন ইতিহাসটাকেইএই যে লুকিয়ে চোখ ধুয়ে ফেলা এ যেন কবিতা লিখতে বসা সেই অস্তিবাদী নায়কের আত্মমনোনয়ন সেই বহুশ্রুত ব্যখা যা সজলের হতে এসেও এক অশ্রুত উচ্চারনে পরিনত হলঅনুভব ও আবিষ্কারের এক স্বতন্ত্র্য স্পেস দিলেন পাঠককেতাঁর পরীক্ষানিরীক্ষা তাঁর কবিতাশিক্ষার মাঝেও  রাখলেন একটা কাটাকাটি একটা সামুয়িক অবোধ কলরবআর এখানেই সজলের নিজস্বতা,পাঠ শেষে পাঠকের সহযোগিতা কাম্য করে আরও একটি প্রক্রিয়া ছেড়ে রাখাসেলাই করে হারিয়ে যাওয়া সাদা বোতামটা পাঠক খুঁজল তার logico-philosophicus এর প্রেক্ষিতে; কবিতার অন্তর্বতী কিছু ইচ্ছাকৃত বর্জনে কিছু এলিমেনেশনে লেখা হয়ে উঠল পাঠকেরই এক নিজস্ব সংগ্রহশালা যেখান থেকে সে তার নিজস্ব শরীরী ভাষা তৈরী করল স্পর্ধিত অভিব্যক্তি তৈরী করল

তবে যেভাবে তৃষ্ণা আমার তরী থেকে কথাবিন্দু প্রায় প্রতিটা বইতেই আলাদা আলাদা ভাবনাগাড়িতে করে সজল ঘুরে বেড়ান ষাট সত্তরের বাংলা কবিতায় পরিব্রাজকের ভূমিকা প্রমানের তাগিদে,যেভাবে তাঁর প্রতিটা বই একে অপরের অচেনা চিনে আত্মীয়তার হাত বাড়ায় তেমনি শব্দের পরিসর বিষয়টিতেও অদ্ভুত বৈপরীত্য বৈচিত্র্য নিয়ে বাংলা সাহিত্যের সাবধানী বৃত্ত অতিক্রম করেছেন সজলঅনুকরন করতে চাননি পৌনঃপুনিকতাতে ,ক্লান্ত হয়ে পড়েননি অসার শব্দভাণ্ডারের কাছে বরং বারবার নতুনের বন্দনা করেছেন,যে সজল অনু কবিতার মাধ্যমে অন্তবর্তী পংক্তির মোহ খুঁড়তে চেয়েছেন সেই সজলই আবার টানা গদ্যে বুনতে চেয়েছেন কবিতার কাঁথাশিল্পঅজানার আগ্রাস থেকে নির্ভার বিস্মরন থেকে বারংবার খুঁজেছেন এক নতুন শুশ্রুষা বারংবার বদলাতে চেয়েছেন তাঁর শাব্দিক প্যাস্টেলগুলো, বোধের- আঙ্গিকের তেলরংগুলো ,কোটেশনে রাখতে চাননি তাঁর কম্পোজিশনকে কেবল সংহত কবিতা বা অনুকবিতাই নয়,শব্দের পরিসর কমিয়ে বোধের বৌদ্ধিকতা বাড়ানোই নয়,টানা গদ্যেও নতুনের  প্রয়াসী হয়েছেন সজল এবং কবিতার ছন্দ বা আঙ্গিকের চিরাচরিত মোহের পথ ,মসৃণ প্রবাহ ত্যাগ করে কবিতার কনটেন্ট ফর্মকে ভেঙেচুরে সাহিত্যের এনগেজড ইন্টেলেকচ্যুয়ালকে নিয়ে গেছেন সমান্তরাল সমঝোতায়, কবিতাকে সংরক্ষিত করতে চাননি কাব্যিক ভাবকথায় বরং মেদ ঝরিয়ে গল্পের আবহ সৃষ্টি করেছেন কবিতার অপেরায়,সেখানে আবার তাৎক্ষনিক সময় নেই,বরং সাত দরজার রাজবাড়ি খুলে রেখেছে মহলের পর মহলআর সেখানেও সাতমহল সাতদরজা পেরিয়েও সজল রেখেছেন অপেক্ষার সনেট টানা গদ্যের ব্যবহার শ্রুতি আন্দোলনের পরিসরে ছিলই আর তাকেই পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে টার্গেট করছেন সজল ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তাঁর ভ্রমন বইয়ের কাহিনীকল্পে,হ্যাঁ ,কবিতা বা দীর্ঘ কবিতা বা গদ্য কবিতা  না বলে সম্পূর্ণ গদ্যতন্ত্রে এক অচিন্ত্যের মুখোমুখি এখানে কবি,যিনি সামনে আসতে চান না,অভিষিক্ত হতে চান না বরং অশুদ্ধস্তর থেকে আরও এক একলা মানুষকে খুঁজে চলেছেন যে তাকে সত্যের দিকে নিয়ে চলেছে ,বিশ্বাস করাচ্ছে নিজেরই সর্বশেষ সাক্ষাৎকার

                 …… কেউ আছে এবং একলা এবং খুঁজছি সেদিন বসের পাদানিতে এক পা আরেকটা কোথায় রাখি এবং তখনই ছুঁয়ে গেল পেছনে তাকিয়ে পাশে তাকিয়ে সে কোথায় ভাবতে ভাবতে নামবার জায়গাসে আরো ভাবিয়ে দিয়ে গেল কি রকম মুখ? আচ্ছা,মুখ কি আছে?নইলে একলা দেখাবে কেন? ……কখনো ভীড়ে কখনো নির্জনে কখনো সকালে কখনো রাতে এবং সেঅথচ এবং অথচ ……অথচ আমি একজন একলা দরজায় দাঁড়িয়ে, সেও একজন একলা কাছে এসে তবুও এবং তবুও এইভাবে একটা খোলা একলার সঙ্গে একলাই একলার বিরুদ্ধে একলা একলার পাশে একলাএকলার পেছনে একলাএকলা একলা একলা থাকার খেলা হার নেইখেলা শেষ জিৎ নেইআবার শুরু কোন নিয়ম নেইকোন জায়গা নেই দুজনকে নিয়ে এক জনের কিংবা একজনকে নিয়ে দুজনের খেলতে ভাল লাগাও নেই, খারাপ লাগাও নেইএকজন একলা ভাবছে আরেকজন একলার সঙ্গে কি করে দেখা হবে আরেকজন একলা আরেকজন একলাকে দেখা দিয়েও দেখা দিচ্ছে না

এভাবেই লিপি নয় বরং সহলিপি নিয়ে সজলের কুলীন-কায়স্থ-করনীয়তাঁর সারাঘরে এমনই এক বিকল্প পথ খোলা রেখে গেছেন সজল যেখান থেকে পাঠকও আলো নিভিয়ে ঢুকে পড়বে নতুন ভিটের খোঁজে, মুখস্থ কাহিনীগুলোর বাইরে সে মনোজগত উড়ন্ত আত্মার,কবিতার জুড়িঘোড়ায় বারবার যেখানে ভুল হয় ফিরে আসার পথ,ফিরে আসার কথা দিয়েও ফিরে না আসার মধ্যে ফিরে যায় পাঠক ছায়ার ছায়া আর কমলা রঙের আরও একটা দরজা খুলে এমনভাবেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন সজল তাঁর গদ্যকবিতাগুলি নিয়ে,গন্ধে গন্ধে মিশে যেতে চাইছেন আরেকজনের গন্ধেএকরাশ ধোঁওয়া,আর সামনে আয়না অথচ চেনা মুখ তখনও অচেনা,কিছুই হারায়নি অথচ খুঁজতে হচ্ছে এক অচিন মুখকেইগদ্যকবিতার গল্পগ্রাম সজলের স্বভাববিরোধী হলেও কোনো বিশৃঙ্খলার ফসল তোলেননি তিনি বরং নির্দিষ্ট উচ্চারনকেই কাব্যের রেখা-স্তর মধ্যবর্তী ভার্টিকাল অলটিটিউডে প্রতিস্থাপিত করেছেন, যেখান থেকে পাঠক পেয়েছে আরও এক নতুন গল্পের টেরিলিন আরও এক নতুন কাহিনীর কৃষ্ণচূড়া শ্রুতি সজলকে শিখিয়েছিল ঘুমন্ত শায়িত শব্দগুলোর মাঝের এক সক্রিয়ে পুনর্জীব্নের পিপাসা, শিখিয়েছিল ভাষার হা খোলা দরজা খুলে কবিতার প্রান্তর ধরে লম্বা একটা দৌড় গদ্যকবিতার ক্রমপ্রসারিত টেক্সট অনুকবিতার সজল কনক্রিট কবিতার সজলকে নিয়ে চলে এমনই এক প্রাসঙ্গিক প্যারাডাইম শিফটে,একটা নিয়ন্ত্রনাধীন বোধবিনিময়ের অঞ্চলে ভ্রমন এর ২৬ জন কবিতাটি উদ্ধৃত করে সজলের দীর্ঘ কবিতাগুলি প্রসঙ্গে কবি প্রাবন্ধিক উত্তম দাশের উক্তি গদ্যকবিতা বিষয়ে সজলের পূর্ণলিরিকটি বুঝতে সাহায্য করেতলিয়ে দেখা যায় গাঢ় জলের কুয়োয় ভেসে থাকা মুক্তকথনের বহুস্বরিক মুখগুলো……“অনেক শব্দই এককছেদ চিহ্নে আলাদাভাবে বিন্যস্তএই শব্দ কখনো নামপদ,কখনো ক্রিয়াপদদু তিনটি শব্দের আলাদা বিন্যাসে অসমাপ্ত বাক্যকিন্তু তার মধ্য দিয়েই অর্থের আভাসচিন্তাস্রোত কখনো পারম্পর্যে ধৃত, কখনো পারম্পর্যহীনএকটা চিন্তা থেকে অন্য চিন্তায় উল্লম্ফন কখনও শব্দানুষঙ্গে তৈরী হচ্ছে দৃশ্যানুষঙ্গ আবার দৃশ্যানুষঙ্গ  থেকে চিন্তার একটা অবয়ব, যা আবার নির্মান করছে চেতনার ভিন্ন ভিন্ন স্তরঅন্তশ্চেতনার স্রোত বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকে আহরন করছে জীবনের নানা আবহ তা অনেক সময় অস্ফুট,ইঙ্গিত-প্রবণ এই অস্ফুট ইঙ্গিত প্রবনতা দিয়েই সজল তার কবিজীবনের মধ্যপর্ব থেকে গড়ে তুলেছেন কবিতার নতুন জগৎ প্রচলিত বাক্য গঠনের যাবতীয় প্রনালী উপেক্ষা করে এই যে আপাত অসংলগ্ন বিন্যাস তাকে ধরে রেখেছে শব্দসঙ্গের অন্তর্নিহিত সুরভাষার অন্তর্গত সুরের এই সঙ্গতি আবিষ্কার করেছেন বলে সজল অনায়াসে তাঁর অবচেতন মনের নানা স্তর খুলতে  খুলতে চলে যান জীবনের প্রবাহে


কবিতার মধ্যেই সজল বন্দোপাধ্যায় দোকানবিহীন সেই ব্যাপারী যিনি বাজারমুখী হতে জানেননি অথবা বলা ভাল হতে চাননি বরং বাংলা কবিতার ঋনের ঘরেও বলতে চেয়েছেন –‘এসো, ভাড়ারে চাল আছে গল্প করি, বলতে চেয়েছেন এসো পরার কাপড় আছে গল্প করি ,-এসো, গল্প করতে করতে বলি বেঁচে আছি তাঁর কবিতার কোলাজবাড়ি একটা প্রচেষ্টা যা বহুদর্শনের প্রীতিপরিপুষ্ট, যা মাঝরাতে ঢেউয়ের উপর হাত রাখবে বলে তীরে গিয়ে নৌকো ছেড়ে দেয় আবার নদীর মানুষকে ফিরিয়ে আনার জন্য বনে ছুটে যায়-তাঁর কবিতার শরীরে এভাবেই উঠে বসেছে বৈচিত্র্যের মানতাসাপ্রশ্ন উঠবে গ্রহীতা সাহিত্যে সজল বন্দোপাধ্যায়ের আনুমানিক অ্যাসিমিলেশনের অনুপাত ঠিক কত !প্রতিটা বইয়ে  যেহুতু সজল পেরিয়ে গেছেন সজলকেই তাই সাথে সাথে রিডার্স রেসপন্সের মাত্রাও পরিবর্তিত হয়েছেকিন্তু তাঁর আঙ্গিকে তাঁর কাব্যিক আঁচলের গিঁটে সবসময় ধরে বেঁধে রেখেছেন একটা অমলিন আনসার্টেন একটা মুক্তবাজার যেখানে পরিশীলিত পাঠক বহুস্বরে আকৃষ্ট হয়েছেনফরাসী সমালোচক রোঁল বার্থে তার দ্য ডেথ অফ দ্য অথর বা রচয়িতার মৃত্যু প্রবন্ধে ভাষার সাথে যুক্ত টেক্সট ও টেক্সটাইলের যোগসূত্র বোঝাতে বলেছেন-“Each piece of writing contains multiple layers and meanings.  "text is a tissue [or fabric] of quotations," drawn from "innumerable centers of culture," rather than from one, individual experience. The essential meaning of a work depends on the impressions of the reader, rather than the "passions" or "tastes" of the writer; "a text's unity lies not in its origins," or its creator, "but in its destination," or its audience.” কবি আর পাঠকের মধ্যবর্তী এই গোপনতাকেন্দ্রের হদিশটুকুই সজলের স্বতন্ত্র্য;সেখানে ঘুমন্ত লেখকের থেকে গড়িয়ে আসছে আলো-ছায়ার পাঠকেরা আর পাঠকের aesthetics of reception  কে প্রতিষ্ঠিত করছে কবির দার্শনিক মননশীলতা;ছবি থেকে ছবিতে,এক ছবির টানে অন্য ছবি নির্মাণ করতে করতে জীবনের এক আবহে নিয়ে চলেছেন পাঠককেপাঠক এক একটি ছবি স্পর্শ করছে আর ক্রমাগত জীবনের মধ্যে রোপন করছে নিজেকে(উত্তম দাশ)সজল বন্দোপাধ্যায়ের কবিতায় রিডার্স পার্টিশিপেশন বা ট্রান্সকালচার কনট্রাস্টের এই যে ছেড়ে রাখা পরিসর সে প্রসংগে সম্পূর্ন প্রাসঙ্গিক না হলেও থার্ড লিটেচারের নতুন ভাষার প্রবর্তক নাট্যকার বাদল সরকারের কিছু চেতনা পরিক্রমা থেকে পাঠককে বঞ্চিত করতে পারছিনা- কে করবে নাট্যায়ন?একজন নির্দেশক?হ্যাঁ,সম্ভবকিন্তু শুধুমাত্র নির্দেশকের নির্দেশের উপর ভরসা করে নির্বিকার চিত্তে অভিনয় করলে কি এ নাটক পৌঁছবে দর্শকের কাছে? যে অভিজ্ঞতা যে চেতনা এ নাটক লেখার তাগিদ এনেছে, সে তাগিদ যদি শুধু নির্দেশকই নেয়,প্রতিটি অভিনেতাও অনুভব না করে,যদি তাদের প্রত্যেকে মনে না করে যে এ নাটক তারই লেখা নাটক,তবে কি নাট্যাভিনয় সার্থক হবে?  নাটক হোক বা কবিতা,স্রষ্টা নামক জাদুকরের কাছে সবই তো শিল্পের ভাড়াটিয়া শরীরটাকে ফুঁ দিয়ে ওড়াতে শেখানো আর প্রতিক্ষেত্রেই পাঠক পাখি ধরে বসে আছে পর্যটকের আদলে সজল বন্দোপাধ্যায় তাঁর কবিতার মধ্যেও ঠিক এমনই পাঠকের নিজস্ব কল্পনাশক্তির একটা দ্বিমাত্রিক ফ্রেম একটা কোয়ান্টাম পৃথিবী ছেড়ে রেখেছেন যার বিশ্বাস জলের কথা ভাবতে ভাবতে জলের কথা ভাবতে ভাবতে জল সে পাবেই


ষাট দশকের অন্যান্য সাহিত্য আন্দোলনপেক্ষা শ্রুতির সজলের ভিন্নতা কবিতার সামাজিক বয়ন থেকে বৃত্তান্তের ইতিহাস থেকে বেড়িয়ে আসা এই উন্মাদ সময়ের সামাজিক অবস্থানকে সজল বন্দোপাধ্যায় তাঁর কবিতায় পৃথক আকারে ট্রান্সক্রিপ্ট করেননি ,বরং প্রথাগত জীবনের আমিগুলি অভিমানগুলি গ্রাভিটিগুলি গমগমগুলিকে করেছেন শব্দের ধারক বাহকফলে তাঁর কবিতায় আসেনি সামাজিক সুড়ঙ্গযুদ্ধের কথা ,বদলে যাপনের নিশিডাকা রক্তসন্ধ্যেগুলো উঠে এসেছে কবির স্বীকারোক্তিতেকোনো বৃহত্তর সমাজ আঁকতে চাননি সজল,কেবল আঁকতে চেয়েছেন সেই আমি কে যে আমি কে কবি রেখে যাচ্ছেন অন্য কারু জন্য অথবা যে আমি কবির কাছে রেখে যাচ্ছে তার জৈবদেহের রুগ্নতা তার জীবনের সেলাই ভাষার শর্তাধীন অবস্থায় থাকেননি সজলবৃত্ত থেকে বৃত্তে ঘুরে বেরালেও কবিতার পকেটে লুকিয়ে রেখেছেন ফিরে আসার এক ক্লর্কওয়াইজ ফ্যাশন, একজন আমি কে নিয়ে এসেছেন মুক্তকথনের প্রয়োজনীয়তায়,যে কেন্দ্র ছাড়েনি, একটা ভঙ্গুরতা অবধি গিয়ে অনুরননতার আবাহনটুকু ছড়িয়ে ফিরে এসেছে আমির কাছে,আর এই আমিকে ঘিরেই  সজলের স্বরলিপিতাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই স্বপ্ন উপকূলের সেই বহুকথিত কবিতা আমি সারাদিন আমি  থেকেই তাঁর এই স্বপ্নের উপকূলে বসে থেকেও ঘরের দিকে ভাসিয়ে দেওয়া মূর্চ্ছনার একটি এবং একটিমাত্র নৌক, যার মুখের বিস্ময়চিহ্নই সজলের শুদ্ধচৈতন্যের আপ্রানমুগ্ধতা

    আমার মা সারাদিন মালা জপেন
         আর আমি
          আমার বোন সারাদিন উন বোনে
         আর আমি
         আমার বউ সারাদিন আলনায় জামাকাপড় সাজায়
          আর আমি
         আমার প্রতিবেশীরা সারাদিন বাড়ি তোলে
         আর আমি
         আমার বন্ধুরা সারাদিন লিফটে চড়ে
    আর আমি

    আমি সারাদিন শুধু আমি ।।

এই কবিতা নিয়ে পরবর্তীকালে সজল বন্দোপাধ্যায় নিজেই বলেছেন-যে যার বৃত্তে ঘুরছে,আমি কিন্তু সম্পূর্ন হয়ে আছি আসলে এক কিঞ্চিৎকর আমিই পাঠের মাঝে রেনুকনা উড়িয়ে যায় সজলের পবিত্র আর্তনাদেরহৃদয়ের ছাঁচে কোথাও শূন্য কুড়োতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সজল তাঁর আগুনের বিবরন বইয়ের লোহার গরাদ কবিতাতেও লক্ষ্য করা যায় এমনই এক স্বাভাবিক আর্তি, মুখের ভেতর দিয়ে নিরিখ করা যায় ভেদরেখাহীন একটা মুখোশের মর্মকথা

   এটা আমার বাড়ি
   এটা আমার শোবার ঘর-
   এটা বসবার ঘর

   এখানে আমার মা থাকে-
   এখানে আমার বউ থাকে-
   এখানে আমার মেয়ে থাকে-

   এটা আমার স্নানঘর-
   নিজে নিজেকে দেখি

   এটা রান্নাঘর-
   ভাতের গন্ধে মো মো করে-
   এটা খাবার টেবিল-
   কত কী সাজানো থাকে

 কিন্তু সব কটা জানলায় যে লোহার গরাদ রয়েছে ।।

এই লোহার গরাদই কি ভাঙতে চাইছেন সজল? নাকি কর্নিয়ায় তুলে রাখছেন কৌনিক অনুপ্রবেশ! আসলে ক্ষনজীবনের শূন্যতা গ্রহনেও তিনি শূন্য দোলন বাজাচ্ছেন ,দুলিয়ে দিচ্ছেন নির্মিতির এক চিত্ররূপময় গুহ্যতাকেকবি মাত্রই তো নির্জনের,তার আবহ-অন্তঃপাটে নিবিড় ভাবে যুক্ত একটা অনতিক্রম দরজা একটা অবশম্ভাবী প্রশিক্ষণ শিবিড় যা গভীরভাবে প্রাকৃতিক ,যার সাজমহলে কবির সাধনা শূন্যের সাজিমাটি বারবার একটা ছায়ার গল্প করেছেন সজল ,যেন অন্ধকারের ভেতর থেকে একদিন বেরিয়ে আসবে আর একটি ছায়া এর কান্না শোনা যায় না/এটা একটা ছায়া/এর হাসি বোঝা যায় না/এটা একটা ছায়া/এ শুধু আলো আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে/এটা একটা ছায়া-জাগতিক ছিলামাটির মাঝে সেই তো  কবির আমি আর এর জন্যই সর্বাঙ্গীন জেগে থাকা এই তো বোধরিক্ত উৎসভ্রমণএই আমির জন্যই সজলের পাইপের তামাক জ্বলছে নিভছে এই আমি র জন্যই তাঁর অনীহা এই আমির জন্যই আন্তরিক রিপিটেশনকোনো সংরক্ষিত কবিতাঞ্চলের নিয়মকানুন মেনে কবিতাচর্চা করেননি সজল, তাই এই আমির মৌরসীপাট্টাতেও নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন লজিকাল ক্র্যাক একটা কালো রবার দিয়ে বারবার সমস্ত নাম মুছে ফেলছেন ,ভাবছেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মত সমস্তকিছু মুছে  দিয়ে যাওয়াই ভালো আর বারবার তিনি নিজের নামের দিকে তাকাচ্ছেন,না, দেখছেন মুছে ফেলতে পারেননি কিছুই,নামের চারপাশেই জড়ো হয়ে আছে সমস্তকিছুআর তিনি বারবার নিজের নাম লিখে চলেছেন বালিয়াড়ীতে, যতবার হাওয়া দিয়েছে যতবার মুছে গেছে ততবার লিখেছেন এক আগন্তুক আমি কে বারবার মাপ নিয়েছেন দূরবীনের,চূড়োর,চওড়ার,হ্যাঁ একটা দিগন্তলীন ভিশনের কাছে ফিরতে চেয়েছেন সজল, হারাতে চেয়েছেন  আসলে ভাষিক সন্ন্যাসীর সাবলম্বনের পিছনে তার আধ্যাত্মিক আত্মোপলব্ধি অপেক্ষাও কোথাও প্রয়োজন এক পরম বিভাজন প্রক্রিয়া,প্রয়োজন তার গাছ থেকে অন্য গাছের চরম তার পাখি থেকে অন্য পাখির দারুন, আসলে কবিতার মধ্যে ভাষার মধ্যে কবির পরিব্রাজক স্বত্ত্বাকে ডিসলোকেট করার ধারনাই এই আমি কে বারবার অন্যপ্রান্তে অন্যদিগন্তে নিয়ে যাওয়া, স্ব-এর প্রতি স্বেচ্ছাচারী গঠনের গায়ত্রীমন্ত্রই কোথাও কবির হাতে তুলে দেয় হাত ফসকে পড়ে যাওয়া সেই রেফকে সেই ড্যাশকে যা মধ্যবর্তী শূন্যতাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে ,এ যেন কবির নিজের সাথেই নিজের এক ফরচুনেট মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং,ফাটল খুঁজেই ঢুকিয়ে দেওয়া প্রেজেন্ট কনট্যিনুয়াস একটা পরিআধেয়কে  যা ক্রমশ কোণ থেকে বদলাচ্ছে কৌনিকে,একটা গভীরতম বিকাশকাল যা তাকে চিরাচরিত নকল লাবন্য থেকে দরজা খুলে দিচ্ছে জলবোবার লবনের দিকেকবিতা বদলাচ্ছে কবিতার ভাষা বদলাচ্ছে,তার নিজের মধ্যেই রয়েছে এক ধরনের বৃদ্ধি একধরনের মিথমোচন,সে তো স্থির নয়, তার শোধন দরকার সংস্থান দরকার,আর্কিটাইপ থেকে খুঁজে বের করা দরকার তার ফল্ট লোকেটরভাষাকে ভরাট থেকে ডেকে নেওয়া দরকার ভাঙনের চিরকূটখানি দিয়ে সজল বন্দোপাধ্যায় বারবার যেন স্পষ্ট প্রতিমানের মাঝে পেতে চেয়েছেন এই অনুচ্চারিত অক্ষর,কালসিন্ধুর মাঝে এক অফুরন্ত আখড়াসম্বল কবি উঠে পড়ছেন দেহনৌকোয় তার ব্যক্তিগত ব্যালাড নিয়ে

কবিতার নিজস্ব ভাষা আর কবির দ্বন্ধ দুনিয়ায় কোনো কিছুই তো স্থির নয়,স্থায়ী নয় বরং শব্দ যেমন বহুলার্থক ভাষাও তেমনি অর্থহীন আকরহীন অভিযানহীন, উচ্চারিত বচন বা la parole এবং জারিত ভাষা বা la langue এই দুইয়ের আসলেই কোন পৃথক অস্তিত্ব নেই সে কেবল কিছু ধ্বনি ও চিহ্নের সদর্থক উপস্থিতিতে অস্তিত্বশীল আর ঠি্ক এখানেই শব্দের পলিসেমিক মেটিরিয়ালগুলোর পরিবর্ধনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে কবিতার নকশাদার গতিতত্ত্বের বিন্যাসেসে বারবার নজির টানে অর্থহীনতার দিকে,তার মধ্যে যে পোয়াতি পরিসর আরও তথাকথিত মহৎ ভাবনার আরোপ থেকে মুক্তি চায় সে ভাষাপুকুরে চান করতে এসে শব্দ তো নিজেই চায় চোখে ঠান্ডা লাগুক, জেনে বুঝে হেঁসো চালিয়ে দেয় চোখ অবধি চিৎকার অবধি কবিতালিপি আসলে একধরনের কম্প্রোমাইজ একধরনের অমোঘ উচ্ছিষ্ট, তাকে যে ধুতেই হবে ,শানপাথরে ঘষে আসতে হবে মেঘভর্তি ডায়েরি,কবি বিপন্ন হবে, কবিতার মেয়েরা ঘর বেঁধে বাচ্চা দিয়ে পরিবার গঠন করলেই তো  এক অসহায় রচয়িতার প্রশ্ন উঠবে ,প্রশ্ন উঠবে নতুন অস্তিত্বরক্ষারকবিতার নতুনত্ব বিষয়ে কবিতাকে কেবল পরীক্ষার অংশ বলতে নারাজ সজল বন্দোপাধ্যায়, তাঁর মতে-এটা শুধু ফর্মাল চেঞ্জ নয়,এরও একটা মূল্য আছে বলে আমি মনে করি আমি সর্বদাই চেয়েছি, আমি আমার মত করে বলব লিখবলোকে যেন কবিতা দেখেই বুঝতে পারে এটা সজল বন্দোপাধ্যায়ের কবিতা-কবিতাটা খারাপ কি ভাল সেটা পরের কথা তাছাড়া আমি মনে করি ওভাবে বললেই আমি ঠিকমত বলতে পারিনতুন কথা বলার তো কিছু নেইএখন শুধু দেখার দৃষ্টীভঙ্গীগত পার্থক্য আর বলার ধরনের রূপভেদ আমি স্বাতন্ত্র্যও চেয়েছি এক অর্থে বিবৃতিধর্মী বাক্যবিন্যাস থেকে সংকেতিত কবিতার নবতর প্রকরণে এই যে উত্তোরন তা্কে কেবলই শ্রুতি আন্দোলনের নিরীক্ষার ফসলের সংজ্ঞায় জারিত করা বোধহয় ঠিক হবে না কারন এক সজলচর্চারও বিদ্যুৎলতা প্রোথিত হয়ে রয়েছে আন্দোলনের ক্ষণপ্রানে যাফরমেয়িশী কবিতার বাইরে প্রভাবমুক্ত পথের অনুসন্ধানে আবেগতরল সজল থেকে পলিসেমিক সজলকে চিহ্নিত করে,যেখানে ভাষার মধ্যে ভগ্নাংশ নির্মাণই তাঁর ভিন্নপ্রয়াসী অভিযাননতুন কবিতার ভূমিকা প্রসঙ্গে শ্রুতির বক্তব্যই ছিল ভেঙে ফেলতে হবে সমস্ত প্রথার শাসন, ছিন্ন করতে হবে সংস্কারের সমস্ত বন্ধন,শব্দকে ব্যবহৃত বাক্যবন্ধের আবর্জনা থেকে এক এক করে বেছে নিতে হবে তৈরী করতে হবে ব্যক্তিগত এবং অনন্য,এক প্রচলমুক্ত বাকরীতিএবং শ্রুতির লক্ষ্যই ছিল গন্ডী ভেঙে বেরিয়ে আসা চিৎকার নয়  নিবিষ্ট উচ্চারন, কারিগরী নির্মান নয় বরং শিল্পসৃষ্টি, বক্তৃতা বা প্রচার নয় বরং নিবিড় অভিজ্ঞতা আর বুদ্ধির চমক নয় কেবল ব্যাকুল সন্ন্যাসআর এভাবেই শিখাহীন শ্রুতির ভেতর আগুনের বিবরন হয়ে অনেকক্ষন ভেসে রইল সজলের বাতাস সজলের ছাইআন্দোলনের লঘুমূর্হুতের বাইরেও রইলেন দ্রষ্টা সজল ,স্বগোতক্তি স্বীকারোক্তির সজল যিনি মিত্থস্ক্রিয়ার যিনি সেমি পারমিয়েবেল হয়ে এক টুকরো জমি এক টুকরো আকাশ এক টুকরো হাওয়া এক টূকরো আলোর থেকে অনাস্থা খুঁজছেন বারবারকবিতার ল্যান্ডস্কেপে নিজেকে নগ্ন করছেন রীতিপ্রথার বাইরে আর নগ্নতা বাড়তে থাকছে নাগাল পেরোতে থাকছে;আসলে এই সজলই আধগোলা কাব্যিক শহরে  রোজ বাড়ি ফেরে একগলা গান নিয়ে রোজ বাড়ি ফেরে বৃষ্টি নিয়ে,টইটম্বুর হয়ে বাড়ি ফেরে রোজ আর ভাষার বুৎপন্ন লিপি থেকে চেতনের পুরোটা থেকে বিচ্ছিন্ন হবার আগের মূর্হুতে উচ্চারিত হয় –“

এগিয়ে চলেছি এগোতেই থাকছি
পাশের অনেকেই ঘুমিয়ে পড়ছে
সাদা চাদরের কথা ভাবতে ভাবতে হাঁপিয়ে পড়েছে
চলার কথা ভাবতে ভাবতে হয়তো আর ফিরবেই না

ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যাচ্ছি-
এগুনোর দিকে
আর শেষের সেই লক্ষ্য
সাহস করে পেছুতেই থাকছে
পেছনের দিকে

একা
এবং অনেকদূরে, এখনও অনেকদূরে

এমনই এক পরিব্রাজক সজল বন্দোপাধ্যায় যার পথের ব্যান্ডিং হয়না,যার গ্রহনের দুপাশ জোড়া যায় না,কেবল প্রান্তরের ভেতরেই তাঁর অনুগমন,নির্দেশহীন বিস্তীর্ণ থাকাই তাঁর নিরুপায় সেখানে ডুবে যাবার কোনো শর্ত নেই,ভেসে ওঠারও,কেবল প্রথম নোয়াকে লক্ষ্য করে বলা আছে নৌকাটা দাও, স্বপ্নের পাল তুলে আমাকে যেতেই হবে ঘুমের ভেতর দিয়ে ওপারেবিন্দু ও বিভঙ্গ নিয়ে ওদিকেই যে সজল বন্দোপাধ্যায়ের ঘর-বাগান-গহনসুখের সিঁড়ি-ওদিকেই যে ঘোড়ার পায়ের শব্দ নিয়ে তাঁর পরবাসী পর্যবেক্ষ



My Blogger Tricks

0 comments:

Post a Comment