Wednesday, July 6, 2016
বুকের
মধ্যে ঘরবাড়ি
জন্মের মুহূর্তে
কালপুরুষ মন্ত্র উচ্চারণ করলেন –
পাণ্ডুলিপি হও –
সেই থেকে ভালবাসার হরফ
ঘৃণার দাঁড়ি
খ্যাতির উদ্ধৃতি-চিহ্ন
অপমানের অর্ধ-ছেদ
নিজেই অক্ষরে অক্ষরে ক্ষতবিক্ষত
একটা পাণ্ডুলিপি
আর শেষে একটা সই –
সজল বন্দ্যোপাধ্যায় [একটি
পাণ্ডুলিপি]
আয়নার ভেতরে চিরচেনা অবয়ব দেখতে দেখতে, অনেকদিনের জমে থাকা
সাদা-কালোয় হাত বোলাতে বোলাতে কি কবিতারা আসে? আত্মরতিতে মেতে ওঠা এই হননঋতুতে তবু
কয়েকজন কি এখনও ঘুমোয় না এতটুকু? যে কারণে, অ্যাপার্টমেন্টের ছাদে আটকে থাকা
চাঁদগুলো খসখসে। অতএব, বিশ্বাস করে নেওয়া যাক, এইসব চাঁদের শেকড়ে একধরনের
স্ফটিক-প্রাসাদ। ব্রায়ার পাইপের হৃৎপিণ্ড থেকে এক রুপোলি চুলের সারেং সেখানে মুঠো
মুঠো শব্দ ওড়ায়। ক্ষুধা-তৃষ্ণার আড়াল থেকে সময় কখনও তার নিজস্ব মেহন-মদির মোসাহেবি
দিয়ে হ্যাঁ-হ্যাঁ-বলা সং সাজে। আর সেই ব্রায়ার পাইপ, একদিন যে কিনা ঝুলে থেকেছিল রাত্রির
সন্ত্রস্ত নীলিমায়, লোলচর্ম নিগারের ঠোঁটে, ক্রমশ হাঁটতে থাকে, শব্দের দৃশ্য থেকে
শ্রুতিতে।
এই সব শব্দই আসলে বাক্যের বেদনাহীন কথা। যার রক্তের চূড়ান্ত
নাটকীয়তা আমাদের বারংবার তছনছ করে। ব্রায়ার পাইপ ঠোঁটে, সেই রুপোলি চুলের সারেং -
এক কবি, তখন বলে ওঠেন :
বৃষ্টির মধ্যে
আমরা বাড়ি ফিরছিলুম
গতরাতের নেশা নিয়ে
আসছে কালের ঘুম নিয়ে
সাদা খরগোশ নিয়ে
লালঘোড়ার লাগাম হাতে নিয়ে –
বুকের মধ্যে যে যার ঘরবাড়ি নিয়ে
হঠাৎ বিস্ফোরণ
পথ রইল না
আমরাও বাড়ি ফিরলুম না
হাঁটতে হাঁটতে ভাবলুম
টেবিলের ওপর খাবার ঠাণ্ডা হচ্ছে
পাইপের মধ্যে তামাক ভিজে যাচ্ছে
কেউ বারান্দার আলো জ্ব্বেলে
ব্লাউজের ছিঁড়ে যাওয়া বোতামটা খুঁজছে
আর আমরা হাঁটছি
আর হাঁটতে হাঁটতে ভোর হচ্ছে [হাঁটতে
হাঁটতে ভোর]
তাঁর স্বপ্নের উপকূলে তিনি হেঁটে গিয়েছিলেন পিকাসোর নীল
জামা গায়ে। সেই যাত্রাপথের সূত্রে, একবার এক গদ্যে তিনি লিখেছিলেন :
কবিতা যে শেষ পর্যন্ত একান্ত ব্যক্তিগত বোধ বা জৈবনিক
অভিজ্ঞতা এবং তার শব্দময় প্রকাশের এক অনির্বচনীয় রসায়নের ফল, সে ব্যাপারে আমার
কোনো দ্বিমত নেই। ... কবির স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর, নিজস্ব ঘরানা, নিজের জগৎ নির্মাণ
যে নিজস্ব ভঙ্গি নির্ভর – এ তো সর্বৈব সত্য। নিজস্ব বোধ সঞ্জাত শব্দ প্রয়োগে,
ধ্বনিবোধে, সমাজবোধে, যোগাযোগ প্রক্রিয়ার অনির্বচনীয় রসায়নে কবিতা ‘কবিতা’ হয়ে
ওঠে। কবি ও পাঠকের সঙ্গসেতু হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত শব্দের সেতু ধরেই কবি পাঠককে
সঙ্গী হিসাবে পায়, এবং পাঠকও কবিকে সঙ্গী করে নেয়। কবিতার ইতিহাস বা চলমানতা শেষ
পর্যন্ত আঙ্গিকের ইতিহাস হয়ে পড়ে। কবি ও পাঠকের সম্মিলনে কবিতাও তেমনি উৎসব –
শব্দের উৎসব। [শব্দের উৎসব]
তাঁর পাণ্ডুরলিপিতে অথচ, লেগে ছিল ব্যক্তিগত ক্ষতের দাগ।
কাছে দূরের আততায়ীরা তাঁকে বারংবার আহত করেছে। তাঁর কবিতা তাই হয়ে উঠেছে একজন
ব্যক্তি মানুষের যন্ত্রণালিপির পাশাপাশি, অনেকজন একা মানুষের গানও। তাঁর কবিতা তাই
শব্দের উৎসব হয়েও, নিছক লাইন ভাঙার, দৃশ্যকল্প রচনা করার, শব্দের জাগ্লারি করার
মনোরম ক্রাফ্ট্ম্যানশিপ নয়। তাঁর কবিতায় নাটকীয়তা আছে, এবং তা চূড়ান্ত অভিঘাত
তৈরি করার জন্যেই, নিছক আবেগজর্জর মেলোড্রামা সে কখনই নয়। চল্লিশের বাংলা কবিতায়
রাজনৈতিক চেতনার যে ছায়া পড়েছিল স্বাভাবিক কারণেই, তাঁর পরবর্তী অধ্যায় যেন বা
শুরু হল ষাট থেকে। পঞ্চাশের কবিতার যে প্রেম, বিপন্নতা, যুবকের আস্ফালন ছিল
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক, ষাটের দশকে হাংরি হোক বা শ্রুতি, তা হয়ে উঠল
ম্যানিফেস্টোবিহীন অথচ সর্বজনীন মুখের আদল। তাই তাঁর ‘২৬শে জানুয়ারি, ১৯৮৫’
কবিতায় যখন ভারত-ভাগ্য-বিধাতার পাশাপাশি ‘একটা মিল খুঁজতে গিয়ে’ আমরা পড়ি এঁটো
পাতা, অথবা যখন, জিরজিরে একটা হাত-এর পরবর্তী স্তবকে প্রতিধ্বনি ওঠে, ভাত ভাত ভাত,
তখন আমাদের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নামে। আত্মধিক্কারের এক অবিন্যস্ত কান্নায়
এক অপরিচিত কষ্ট আমাদের দম বন্ধ করে দেয়। আমরা টের পাই, সেই কবি, আর শুধুমাত্র
শ্রুতি কবিতা আন্দোলনের ঘেরাটোপে বসে নেই, তিনি আসলে প্রবলভাবে রাজনৈতিক, সমকালীন
সময়ের এক মুখ।
শূন্যতার ভেতরে যে কী এক রহস্য লুকিয়ে আছে, তা কি কখনও তাঁর
ধারনার বাইরে ছিল? দেখা না দেখার সমস্ত দূরত্ব লিখতে লিখতে আয়নার ফ্রিজিং পয়েন্টের
দেশে তিনিও কি বারংবার নিজের সঙ্গে কথা বলেননি? আমরা দেখেছিলাম – জীবনানন্দ
সভাগৃহে সেই সন্ধ্যায়, কেমন করে সেই কবির স্বতঃস্ফুর্ত সেন্স অফ হিউমার আর
ব্যক্তিত্বের ঔজ্জ্বল্যে এক নিজস্ব বলয় নির্মিত হয়ে উঠছিল। আমাদের অনেকের
ব্যক্তিগত দুঃখ, তাঁর কবিতার কোনো বই আমরা সংগ্রহ করে পড়তে পারিনি, অথচ, নানা
সংকলনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাঁর কবিতা নিয়েই তিনি আমাদের অন্যতম প্রিয় কবি। সেইসব
হাতে গোনা মণিমুক্তো দিয়েই আমরা আমাদের ব্যক্তিগত প্রতিবেদন রচনা করেছি। আজ যদি,
বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়ার আগে, একবার সেই সমস্ত কবিতাকে জড়ো করে প্রকাশ করার
দাবী ওঠে, তা কি এক মহৎ কর্তব্যপালন হয়ে উঠবে না?
আজ যখন আমাদের নাশকতার দেবদূতেরা প্রবলভাবে ঝাঁকুনি দেয়
আমাদের, আর আমরা দেখতে পাই, সার্কাস এরিনায় খেলা দেখিয়ে চলা মাল্টিকালার ভাঁড়েদের
হাততালি, তখন আচমকা যখন মুখের ওপর এসে পড়ে প্রিয় কোনো কবিতার ছায়া, তখন কি আরও
একবার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না সেই অমোঘ বাক্যবন্ধকে, যে, কবিই সবচাইতে বড়
প্রফেট?
আসলে
ছোটঘরে থাকতে থাকতে
এমনই হয় –
পাহাড়ের সামনে ভয় পাওয়া
নদীর সামনে কাঁপতে থাকা
প্রান্তরে দাঁড়ালে দিক-ভুল
বাড়িয়ে দেওয়া হাত দেখলে অবিশ্বাস
ঠোঁট দেখলে চকচকে দাঁত
ছোট্ট ঘরে থাকতে থাকতে
নিজে নিজের সঙ্গে
নিজে নিজের সঙ্গে [অভ্যাস]
আবারও বলি, তাঁর কবিতা এই নিজে নিজের সঙ্গে থাকাটুকুই নয়। নয়
কেবলমাত্র শব্দের নিঃসঙ্গ কারুকাজ, শোকপ্রস্তাব পাঠের আরামকেদারা। তার কবিতা বরং
এক ক্যানভাস – যেখানে দৃশ্য এবং অ-দৃশ্য, গুণ এবং নির্গুণ, গম্য এবং অ-চলের
কলমকারি। কেবল শব্দ দিয়ে তৈরি প্রাসাদের সিপিয়া-রং ফোটোগ্রাফে একদিন অন্যমনস্কতার
পাতা ঝরে যায়। কথার বাগানে সেদিন উড়তে থাকে জনহীন সৈকতে পড়ে থাকা সিগারেটের ছাই।
কিন্তু তাঁর কবিতা তো ভরপুর জীবনের আদর। তাই সেখানে জলবিন্দু চুঁইয়ে নামে।
আত্মপ্রতিকৃতির ফুটপাথ রঙিন হয়ে ওঠে। আমরা তখন সেইসব সন্ধের নির্বাসনে একে একে
খুলে ফেলি বর্মসজ্জা। আমাদের দিন ও মেঘের ছায়ায় একে একে নদীরাও জামা খোলে। জলের
হাওয়া লেগে যায় পায়রাডানায়। আমাদের কাঁপতে থাকা সন্ধিপ্রস্তাবগুলোয় সেই সময়ে হাত
রাখে কবিতা ডাকনামের এক পাখি।
পায়রার ডানায় সেই দিন এবং মেঘের ছায়া
ধানক্ষেতের আলের মত দীর্ঘ যার ওপর দুহাত
রক্ত নিয়ে বুকের মধ্যে সকলে একে একে রৌদ্র নদী
মৌমাছির পায়ে নীল ফুলের ছাপ
দুটি মাছরাঙা ঠোঁটে রূপোর টুকরো
বাঁশের পাতায় জলের হাওয়া
দুটো হাত
দিনটা থিরতিরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে
নৌকার মাস্তুলে আস্তে আস্তে
একটা সমস্ত রঙের পাখি [মুখোমুখি]
তাঁর কবিতা এক সমাজবোধের মানচিত্র। এখানে গুহাপথে লুকিয়ে
থাকে শ্বাপদেরা। যারা অতর্কিতে ঝাঁপায় ঘাড়ের ওপর। সেই গেরিলা যুদ্ধে, তাঁর কবিতা
হয়ে ওঠে অস্ত্র। যত বেশি পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের নীরবতা, যত বেশি আমাদের মগজে
কার্ফিউ, তত বেশি করে কবিতারা এসে আমাদের হাজার হাজার ঘুমন্ত স্মৃতিকণা সূচবিদ্ধ
করে।
হাততালি দিতেই থেমে গেল। শরীরে অসংখ্য
চাঁদের ছায়া গান করতে করতে চাঁদের মধ্যে মিশে গেল।
খসখস পাতার শব্দ। আমি। হাওয়া পাতার ওপর
পা ফেলে চলেছে। তারপর পথটা আর দেখা গেল না।
খস্খস্ খস্খস্ পাতার শব্দ। ভিতরে যাও, ভিতরে যাও,
ভিতরে যাও। হাততালি দিতেও আমার বুকের ওপরে
বরফের মত ছোঁয়া। গান অন্ধকার টলটলে জল ফুল
পাহাড় মন্দির স্বপ্ন এবং আমার ঘুমে আমি
সকলের স্বপ্নের মধ্যে দেবতার মত হঠাৎ এসে দাঁড়ালাম।
সকলে চোখ বন্ধ করে দেখল আম তাদের মন্দিরের
ভেতরে চলে যেতে যেতে তাদের স্বপ্নে আমার স্বপ্নে [মন্দিরের
মধ্যে]
এই আপাত স্যুররিয়াল পৃথিবীতে এক অসম-যুদ্ধে আত্মলিখনটুকুই
তখন হয়ে ওঠে প্রতিরোধপ্রস্তাবের একমাত্র খড়কুটো। এভাবেই আমাদের স্বপ্ন নির্মিত হয়।
এভাবেই সজল বন্দ্যোপাধ্যায় স্বপ্ন নির্মাণ করেন।
[এ লেখার শিরোনামের সূত্র কবি সজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক
কবিতা-পংক্তি]
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment