পরিচালক বাক্
Wednesday, July 6, 2016
কারুবাসনা যাকে নষ্ট করেছে সে-ই কবি। যার মাথায় প্রতিষ্ঠানের বিরাট বিরাট
নখওয়ালা হাত, যার সঙ্গে হাসিমুখে ছবি তুলছেন প্রতাপান্বিত কবি, যে রাষ্ট্রের ছাতার
বাঁট সজোরে ধরে আছে যাতে অকালবৃষ্টিতে ভিজে না যায়, যে বিদ্রোহী কবিতাকে দমন করতে
তৎপর, যে কোনো অন্যরকম লেখাকে যে বিদ্রূপ করে- সে কবি কেন হবে? সমাজে চতুরের ভেকের
অভাব নেই। কেউ সমাজসেবী সাজে, কেউ পলিটিশিয়ান, কেউ কবি।
আচ্ছা, বাণিজ্যিক কাগজে কবিতা লিখে যদি ৩০০ টাকা পাওয়া যায়, গল্প লিখলে
নাকি ২০০০ মেলে। কেন? কবিতার চেয়ে গল্পের দাম বেশি বলে, নাকি গল্প লিখতে অনেক শব্দ
লাগে বলে? যদি দীর্ঘকবিতা হয়?
‘তাজমহল দেখলাম। মোটামুটি লাগল। আরো ভালো
হতে পারত। পুরো সাদা না করে একটু কালো রঙ ব্যবহার করা যেত। সামনের বাগানটায় কিছু
পেয়ারা গাছ থাকলে পেড়ে খাওয়া যেত।’- আনন্দবাজারের সাহিত্য-শিল্প আর সিনেমার আলোচনা
ঠিক এভাবে হয়। আর আনন্দবাজার থেকেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি ঠিক করে নেয় কোন-কোন
‘বই’ দ্যাখার মতো, বা পড়ার মতো হয়েছে, কে আজ ‘ভালো’ লেখক, কে ‘দারুণ’ পরিচালক।
জীবনানন্দ দাশের কবিতার কোনো মূল্য আজ আর
নেই। তাঁকে পড়ে আজও কবিতা পড়ার অসীম আনন্দ পাওয়া যায়, এটুকুই। কবিদের কবি তিনি আজ আর নন। প্রতিষ্ঠান তবু তাঁর কবিতা আর মিথ-কে
জাগিয়ে রাখতে চায়, কারন আজকের
প্রাতিষ্ঠানিক বস্তাপচা কবিতার ভিত তিনি সরে গেলে কিছুই বাকি থাকে না। যখন তিনি
সত্যিই প্রয়োজনীয় কাজগুলো করছিলেন, বাংলা কবিতার বাঁক
ফেরাচ্ছিলেন, জীবনানন্দকে অবহেলা ছাড়া কিছু দেওয়া হয়নি। চরম
অবজ্ঞা আর অবিচারের মধ্যে লোকটিকে মরতে হয়েছিল। আজ তাঁর মিথ্যে পুজোর মধ্যে সেই
অনুতাপ লক্ষ্য করা যায় না। আজ বরং তাঁর উপন্যাসগুলো অনেক প্রাসঙ্গিক। জীবনানন্দ
আজও উপন্যাস লেখক হিসেবে এখনকার যে কোনো জীবিত ঔপন্যাসিকের চেয়ে মহৎ এবং জ্যান্ত।
কিন্তু তাঁর উপন্যাস এখানে পড়াই হয় না। পাওয়াই যায় না। অনেকেই শুধু 'বনলতা সেন' পড়ে। 'কারুবাসনা'
বা 'জলপাইহাটি'-র দিকে
ফিরেও তাকায় না।
কোনো বিপ্লবীই ব্যর্থ হননি। কারন কোনো
বিপ্লবই আজ অবধি বিফল হয়নি। বিপ্লবকে হাতের মুঠোয় নিয়ে যখন দেখতে পাচ্ছেন, সে তখনও
কাঁচা। বিপ্লবের পরিণতি যখন সে একটা বিদীর্ণ ফলের মতো মাটিতে পড়ে থাকে। আর তার
বীজগুলো চতুর্দিকে ছড়িয়ে যায়। যে গাছগুলো পরে হবে, তারা ওই বিপ্লবের জেনেটিক
উত্তরাধিকার বহন করে। তারা সচেতন কিনা, পরের কথা।
এ দেশের মানুষ বিশ্বাস করে- ‘অতি বাড় বেড়ো
না, ঝড়ে পড়ে যাবে’। এ-দেশের মানুষ সন্তানকে শিক্ষা দ্যায়- ‘আগে গেলে বাঘে খায়/
পিছে গেলে সোনা পায়’। এ-দেশে দোকানের সামনে
লেবুলংকা ঝোলানো আজ কম্পালসারি হয়ে উঠছে। এ-দেশে বিরাট বাড়ি করলে তার সামনে জুতো
ঝুলিয়ে রাখতে হয়।
এ-দেশে কবিতা লিখে আপনি কী করবেন, ‘দেশ’-এ
কোবিতা ছাপানো ছাড়া আর কোন কৃতিত্ব আপনি আশা করতে পারেন?
অনুপম মুখোপাধ্যায়
পরিচালক বাক্
পরিচালক বাক্
নিবন্ত
একটা প্রদীপ
আলোর ভিতর দিয়ে ছুটে চলেছে
আলো
মুখর হয়েছে, তাতে তার কিছু যায় আসে না
সে
স্বাধীন, সে আত্মসচেতন, সে কিছু দেখছে না,
সে কিছু দেখতে চাইছে না।
সে
গান নয় প্রার্থনা নয়। মন্ত্র নয়। সে মন্দিরের চূড়ার
অভিলাষী
নয়, সে মিছিলের দাবি-দাওয়াকে
অস্বীকার করছে
দশরঙের
ফুল আর বাগানের ঐকতান
নিবন্ত একটা প্রদীপ
কোনো বার্তা নয়
তার
যাওয়া নির্নিমেষ একটা যাওয়া।
ওই
দেখ সে মেঘ ছিন্ন করে
ছিন্নভিন্ন করে
আরো
নিঃসংশয়।
সে
জানেও না তার একজন প্রেমিক আছে
বন্ধু আছে, সহযাত্রী আছে।
জার্নি বাই আশ্বিন
ছোঁয়া লেগেছিলো; কেঁপে ওঠা গোলাপ ফলের
গায়ে
তাকিয়ে রয়েছে নীল বিড়ালের চোখ
প্রান্তরে ঘাসের উপরে ময়ূরের পালক ঝরছে
তাকে তুমি কুয়াশা বলছো
!
আশ্বিন; যা আসলে একটি নদীর নাম
তাঁর জলে বুক থেকে কাপড় সরিয়ে
স্নান করছে যে মেয়েটি
শরীরে তারও কিছু
আশ্বিন জেগেছে
ভালো লাগছে আশ্বিনের রং ও রোদ্দুর
সঙ্গীতসন্ধ্যা
গানমিস্ত্রি। হাতে ধরা লঘু ও উচ্চাঙ্গের
রহস্য খুলবার মস্ত এক রেঞ্জ
এইখানে সুরটুকু খানিকটা লঘু তালে হোক
ওইখানে খানিকটা উচ্চাঙ্গ লাগুক
রকমারি সুরে গাইছে সান্ধ্য রেডিও
একটি পেন্সিলস্কেচ চিত্র প্রদর্শনীর সমালোচনা
‘গরুর পালের মধ্যে বাঘপরার দৃশ্য’ এঁকে
কি বোঝাতে চাইছ এখানে ?
অস্পষ্ট ধোঁয়াশা ও একরঙা
পেন্সিলস্কেচগুলোর মধ্যে কোন রক্তকাণ্ড নেই
তার চেয়েঢের ভালো লিপিস্টিকের দিকে
তাকিয়ে
এক রক্ত নদী সাতরায়ে ডাঙ্গায় উঠছি
নামকাটা
পাতারা রোদে থাকে আর তাকানোরা হাওয়ায়
আকাশ জানে নিরুপায় সে
উদাসীন মাঝে মধ্যে নৈঋতে বের হয়।
তাদের আষাঢ় ফিরে তাকানোর পর্যটন থাকে
না তাই
তারা চিবুক খুঁজতে বেরোয়।
মাঠ চেয়ে চেয়ে নেমে যাওয়া চোখ
অপলক সন্ধ্যা,
ঝুঁকি ও পা ফস্কে চুড়িদার
ফেরত এইসব রং, পায়ের
ছায়া,তাদের কোন অফিস নেই
ছোট ছোট মুগ্ধ দোকানপাট,
তুলনামূলক আঙুল
যারা সস্তার দিক নির্দেশ করে,
নিচু , নিঃশব্দে
অক্সিজেন ভর্তি টিফিন, বাড়ি ফিরতে অনেক নাম হয়ে যায়।
এক,
একটা
তোমার চোখের আমলকী আমাকে দাও
রোদের প্রকৃত এসে লাগুক কপালে
সেই কবেকার অভাবে তুমি চিচিঙে
রেঁধেছিলে
লালকমল নীলকমল সাইকেলে সন্ধ্যের মুখেই
লন্ঠনের পাশে নিশ্চিত হারমনিয়াম
আয়ত্তের মধ্যে ছিল না সেইসব জানালার
কাঁচ
কেবল ভেজা,
শান্ত পাশের বাড়ির
শুভাকাঙ্ক্ষী সেপটিপিন
পাজামায় দড়ি
ভরে দিত আঙুলের পরিষেবা
..........রমেশচন্দ্র
তালুকদার.........
(১৯৫৪-২০১৪)
(প্রকাশিত গ্রন্থ- -“কুচকাওয়াজের তালবিথী”, “তুমিহীন সরলতা’, “দ্বিধান্বিত বিষাদঃ অরুন্তদ
অস্থিরতা”, “মরণমৌসুমী”)
সেই কবেই ‘তেল নুন লকড়ি’তে
প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন-‘অতীতের জ্ঞানশূন্য হয়ে কোনো জাতি জাতীয় আত্মার সন্ধান
পায়না, জাতীয় আত্মোন্নতি দূরে থাকুক”...আর “পরিবর্তন যেমন কালসাপেক্ষ, পরিবর্ধন
তেমনি দেশ ও পাত্র সাপেক্ষ। আমাদের প্রত্যেকেরই দেহ মনের মূলে পূর্বপুরুষরা বিরাজ
করছেন, এবং আমাদের জাতীয় সভ্যতা অর্থাৎ সামাজিকতার মূলে পূর্বপুরুষদের সমাজ বিরাজ
করছে। বংশপরম্পরা হেরিডিটি হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো উন্নতি অসম্ভব”-
আধুনিকতা,প্রবহমানতা ধরে ধরে এগিয়ে গিয়েও জন্মসূত্রের একধরনের শিকড়ব্যাপ্ত দুঃসহ
নিঃসঙ্গতাই হয়ত বাংলা সাহিত্যের বীরবলকে দিয়ে এমন লেখা লিখিয়েছিল । কিন্তু এর
মধ্যে কেবল ভৌগলিক পরিসীমা বা পেট্রিয়টিজমের অটুট চরিত্রই কি বর্তমান? নাকি এর
ভেতর আদতে স্মৃতি-বিস্মৃতির এক অভিমানী ভাষা অশরীরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ! সারাটা কাল
সমকালকে সুখী করতে ঠিক যেমন স্মৃতির পাতায় হারিয়ে গেছে ‘দুঃখিনী বর্ণমালা’ আর আমরা
বাংলা কবিতার সিম্ফনি উচ্চারণ করতে করতে নিজেদেরকে ভাবছি আলোক বিস্ময়ের অধিকারী
অথচ ভাবছি না বাংলা কবিতার সারা পা ঝিনঝিন করছে কখন যেন, স্মরণের বাতিটা নিভে
যাচ্ছে একের পর এক, ফলে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক কবিতার এমন আলোর বাতি নিয়ে কি
হবে, যেখানে আসলে অন্ধকারের মাশুল বেড়েই চলেছে ? বাঙালী বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি , তাই
খুব স্বাভাবিক তাপ্পিসর্বস্ব বাংলা সাহিত্যে চালু সংস্কৃতির লোক না হলে কবি থেকে
যাবেন নিঃসঙ্গ অবহেলিত। কিন্তু সমকালীন ও পরবর্তী পাঠকের কাছে একজন পূর্বজ লেখকের
এমন কৃতঘ্ন বিস্মৃতি কি কেবলমাত্র তাঁর সৃষ্টিকে প্রত্যাখান নাকি একজন অনুজ কবি – লেখকের কাছে সামগ্রিক বাঙলা
কবিতার কালচেতনার নির্ভুল দিশা পাওয়ার অন্তরায় এমন বিস্মৃতিকাতরতা! অথচ কুলীন
বাংলাসাহিত্যের জনসংঘট্টের বাইরে থেকে যাওয়া অর্ধপরিচিত অপরিচিত স্রষ্টাদের
ব্রতঘরেই পড়ে আছে বাংলা কবিতার সার্বিক সুগন্ধ। বর্ধমানের রমেশচন্দ্র তালুকদার
এমনই একজন কবি যিনি ‘আবহমানের’ কবিতা লিখেও আবহমান বাংলা কবিতায় রয়ে গেলেন
প্রান্তিক। আশির দশকের কবি রমেশচন্দ তালুকদার , যিনি লিখলেন –“ফুঁ দিয়ে নেভানো হল
করতলধৃত মৃদু ভাষা/ দেখা হলো সীমাহীন”। তাঁর
সামগ্রিক কবিতাযাপনই এমনই এক অনায়াস নিরবধির দিকে। না, ব্যক্তি রমেশচন্দ্র কে আমি
চিনিনা,জানিনা, আর সামান্য ব্যক্তিক অভিধায় একজন কবিকে তাঁর পংক্তিবলয়কে বেঁধে
ফেলতেও চাইনা ,তবে জীবন ক্ষরণে তিনি যেমন ছিলেন প্রচারবিমুখ তেমনি কবিতাতেও এই
সাদা স্থির পর্যবেক্ষণটাই ছিল তাঁর পৌঁছোবার লক্ষ্য । তাঁর নান্দনিক যোজনাতেও
নিঃশব্দেরই রেশ পাওয়া যায় ; কেন কবিতা লিখতেন , কবির মুখ থেকে তা জানা সম্ভব নয়
কিন্তু তাঁর কবিতারাই জানিয়ে যায় বাকবিশ্বকে নতুন করে নতুন উচ্চারণে রচনা করার
মধ্যে দিয়ে তিনি যেন অভিসন্ধিহীন একটা অসীমের সন্ধান করে গেছেন। শিষ্ট শব্দের
মধ্যে ঢুকে পড়েছেন নতুনের শোভাযাত্রা নিয়ে আর কবির মধ্যে যে কবি থাকে তাকে যেন
বারবার বলেছেন কবিতামন্ডল থেকে বেরিয়ে আসতে। স্পৃশ্য,স্মৃতির থেকে এই ভ্রমণেই যে
রমেশচন্দ্রের ‘অহংকার’, তাঁর নিজস্ব সংলাপেও এমনই এক যাত্রার উদ্দেশে জেগে থাকার
তর্জমা পাই –“ যেভাবে ফড়িং তার হেমন্তের কাছে চলে যায়/ চলে যায় ছাড়পত্রহীন-/ধানের
গুছির নীচে সেতুহীন রাত্রিযাপন/লুকোন ঠোঁটের ময়লা হেমন্তের মৌন সমর্থন/সব নিয়ে
নির্বাসনে যায়”-
কিন্তু শব্দের মেদমাংস
থেকে নিঃশব্দের জন্মমন্ত্রে যেতে হলে ঠিক “কতখানি ছাড়া দেব? আর , কাকে?”-এ কেবল রবীর
বলে যাওয়া কথা নয় , আসলে যুগে যুগে যেকোনো শিল্পে রূপ থেকে রূপান্তরে যেতে এই ছাড়ের
প্রশ্নটাই প্রাথমিক, ‘সংগীতে যেমন গানের গতি তরল’ তেমনি রমেশচন্দ্রের কবিতায়
শব্দের থেকে চোখের গতি অনেকবেশি , অনেক ছাড় ওই চোখে, নাহলে কিভাবে দেখলেন-“ কেউ
স্মৃতির মন্দার থেকে গোলাপী বেলুন/ নম্র হয়ে উড়ে যাচ্ছে দেখে/ কিছু কিছু ঘাসে
/বরফকুচির তীব্র ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডেকে উঠছে/পারুল – পারুল -/ লাল রং তার পায়ে ... লাল
ধুলো/ সে অনেক দূর-“... বস্তুর সীমানা সরহদ্দের থেকে কি বস্তুগুন বিবর্জিত আরও এক
সীমাহীনতার কাছেই ছিল রমেশচন্দ্রের অভিব্যঞ্জনা ! যে সময়ে তিনি লিখতে এসেছিলেন সে
সময়কালে সামাজিক রাজনৈতিক উত্তালতা কোথাও বাংলা কবিতা ও সমসাময়িক সাহিত্যে কিছুটা
হলেও গাম্পশন ট্র্যাপের ভূমিকা নিয়েছিল ফলে জীবনের সাথে কবিতার প্রত্যক্ষ
মিশ্রজীবিতার প্রভুত উদাহরন এসময়, সাহিত্যের শেকড়ে জড়িয়ে গেছে সমাজের অবক্ষয় হতাশা
সংশয়। অথচ রমেশচন্দ্র তালুকদার ঠিক এ জায়গাতেই
জীবন থেকে বেরোতে চাইলেন, অথচ তাকে গান স্যালুট দিয়ে নয় বরং চেতনার এক গুপ্তপ্রেসে
নিয়ে গেলেন জীবনকে, ফলে লৌকিক কবিতাই অলৌকিক অচেনা গলির বাঁধাইয়ে ধরা পড়ল
রমেশচন্দ্রের হাতে। এই নিজস্বতাই হয়ত খুঁজে গেছেন প্রথম থেকে। এ প্রসঙ্গে তাঁর
কবিতা যাপনের সহযোদ্ধা কুমুদবন্ধু নাথের কিছু কথা খুবই প্রাসঙ্গিক –“ বারবার
নৈঃশব্দকে ছুঁতে চেয়েছে, তার নাগাল পেয়েছে কিনা জানিনা। তবে কোনোদিন অস্থির ছিলো
না। ছেনে ছুনে দেখতে পেয়েছে অমরতা কাকে বলে। .........সে বলতো প্রত্যেক কবিই তার
নিজস্বতা নিয়ে বেঁচে থাকে । আমাদেরও সে ক্ষমতা অর্জন করতে হবে । প্রত্যাখান অনবরত
প্রত্যাখান আসবেই তাতেও যেন দমে না যাই। জয় একদিন হবেই।“-চেতনা সম্প্রসারণের কবিতা
রমেশচন্দ্রের , জীবনের কথা বলতে বলতে জীবনকেই যেখানে সন্দেহ করে বসেন কবি; সন্দেহ
করে ওঠেন বাঁচাটাকে আর আদ্যন্ত নিস্পৃহ এক ‘আমি’ অনুভব করতে শুরু করে কবি হারিয়ে
যাচ্ছেন ,টেকসই চিহ্ন থেকে কবিতা হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে অচিহ্নের দিকে, এই
নির্মাণপ্রক্রিয়ায় দাঁড়িয়েই তিনি বলে ওঠেন –“এ গন্ধশাসিত সব শিরা উপশিরা অসম্ভব
ভারী হয়ে ওঠে/ আমি ভারী হয়ে উঠে ঘুমের আহারে,/ আমার আহারে সেই।/গন্ধবহ জুঁইলীন হয়ে
আসে ক্রমান্বয়ে/আমি/আমি/আমি...”।ফরাসি
ঔপন্যাসিক Marguerite
Yourcenar যেমন বলতেন ‘Books are not life. Only its
ashes”-রমেশ্চন্দ্র তালুকদারের কবিতাও তেমনি বিষয় থেকে বিষয়হীন
সংকেতের দিকে জীবনের ছাঁই ঘাঁটা দস্তাবেজ, যেখানে যতিহীন সম্পর্করেখগুলি আমাদের
পরম্পরা থেকে নিয়ে চলে অসীমতায়।
এ লেখা লিখতে লিখতেই খবর এল
ইরানীয়ান পরিচালক আব্বাস কিয়ারোস্তামি আর নেই, মনে পড়ছে “ আর্ট অফ লিভিং” নামে তাঁর
ওপর নির্মিত তথ্যচিত্রে কিয়ারোস্তামির প্রাথমিক কিছু কথা- - If you
want to become a good writer , you just keep writing & writing and writing.
So in response to the question of how to develop a good aesthetic vision, I can
say that you have to keep seeing and seeing and seeing...
রমেশচন্দ্র তালুকদারের মত কবিতার প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধে অনীহ কবিরাও বুঝি নিভৃতে
শব্দের আনন্দশরীরে ঢুকে পড়েন কেবলমাত্র অন্তরতর দৃশ্যটিকে এমনই এক দেখবার
তাগিদে-আমৃত্যু-আজীবন-বিনিময়যোগ্য বিলিবন্টনে যার আয়তন পাওয়া দুষ্কর-
বাংলা কবিতার
সন্ধ্যাস্রোতে দাঁড়িয়ে দলছুট অক্ষহীন হয়ে আমাদেরই খুঁজে নিতে হবে হারিয়ে যাওয়া এমন
সব বিরোধী কন্ঠস্বরকে... (রমিত
দে)
(বিশেষভাবে ঋণস্বীকারঃ- সুকান্ত দে , তিতাস বন্দোপাধ্যায়-যাদের
অকুন্ঠ আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া রমেশ চন্দ্র তালুকদারের এক গুচ্ছ কবিতাকে সম্ভবত এই
প্রথম আমরা আন্তর্জালে আত্মপ্রকাশ করাতে পারতাম না , বারংবার আমার আবদার মেনে তারা
যেভাবে তথ্য সরবরাহ করে গেছেন তাতে তাদের ভালোবাসার প্রতি আমি আন্তরিক ঋণী।ভবিষ্যৎ
প্রজন্মের কাছে বাংলা কবিতা ও কবিদের অনন্ত প্রবহমানতাকে জীবন্ত ও প্রোজ্জ্বল
রাখতে আশা রাখব এমনভাবেই এগিয়ে আসবে কবিবন্ধু সবাই )
স্তব্ধতা
সরলবর্গীয় বন ফুটো করে পোকার গর্তের মতো
ইলেকট্রিক তার চলে গেছে
এই দৃশ্য কোথায় দেখেছি মনে পড়ছে না এখন
চারকোনা শহর জুড়ে জ্বলন্ত দড়ির ফাঁস
আয়না আর কাঠের আগ্নেয় স্টল,বিস্মরণ রোমহীন গঙ্গাফড়িং
নিয়ে প্রকৃতির ধবল অসুখ শুধু ছুঁয়ে দেয় চুল
হলুদ- হলুদ পাতা- ওড়াওড়ি-ফনাহীন জি টি রোড
চেটে নেয় দুমাইল জিভে
গাছ নেই যতদূর দেখা যায়; লোহার মিনারে সাঁটা বিজ্ঞাপন-
টায়ার ও সেলুলয়েডের মুখ
অর্থাৎ মিহিন তার, সরলবর্গীয় বন এদের প্রকৃত কোনো
মানে নেই এই ধাতু বিস্তৃত শহরে
আমরা কি ছিঁড়ে ফেলবো, ছিঁড়ে ফেলতে চাই
অনন্তের মাঝামাঝি,নিস্তরঙ্গ- ফুঁড়ে যাচ্ছে ইলেকট্রিক তার
ঝিঁঝিঁর চিৎকারে শুধু মাঝে মাঝে, ডবলডেকার থেকে
লাফ দেয় হলুদবিদ্যুৎ ডোরাকাটা , ঝলসে ওঠে
তারে তারে লেগে জলে অগ্নির সন্ত্রাস যেন
ঝনঝন শব্দে বন কেঁপে উঠলো ঃ
অপেক্ষা- অপেক্ষা দশদিক
প্লাস্টিক, কারখানা, চিমনি-নীলিমা ফাটানো
বন্য বরাহের দাঁত
অনেক সিগ্রেট মুখে রক্তনীল পাথরের
জ্বলন্ত আগুন কাঠের গোলায় কারা ধরিয়ে রেখেছে
আটা চাকী থেকে ভোঁতা হিসহিস শব্দ ওঠে
পাশে বন মানে
এই অর্থহীন মিহিন পোকার গর্ত তার
কোথায় দেখেছি মনে পড়ছে না এখন
মুকুলের অন্ধকার
হাঁক দিলো ঐ পাড়ে পাতায় পাতায় অবসর
খোলে কি
খোলে না চোখ
দুপুর বেলার ঢেউ- ফেনায়
মুক্তোর হিম-সাদা
হাঁক দিলো সাদা আর আঁকানো বাঁকানো জাগরণ
এতো
স্থির ; অপলক – সারাবেলা
গুমগুম
শব্দে ভেঙে পড়ে
আম জাম পেয়ারা জারুল –
এপাড় ওপাড় শুধু –
কচি কচি পাতার আঙুল হিম ছুঁয়ে জেগে থাকে
অবিরল পাতা ভেঙে
হাঁক দেয়
গড়ানো কাজল –
ধুলো ছুঁয়ে নামে কাক
গড়িয়ে
ছড়িয়ে যায় হলুদ ঝর্ঝর, নির্জনতা
এপাড়
ওপাড়
ডানায় ধুলোয়ও নয় কা কা নয়
আকাশ
পাতায় ঝেঁপে চলে গেছে
যতদূর
যায় –
একটি ধূলোর লাল দুপুরবেলার ঢেউ
গুমগুম
শব্দ ছুঁয়ে থাকে
কাক চিল অপলক – তলিয়ে তলিয়ে যায়
দুপুর
বেলার হিমে –সাদা -
ক্লীব
ভস্ম কি অধিক ছিলো তাই আগুনের হলাহল
বোঝাতে পারিনি কোনদিনই
আড়ালে হিসহিস শব্দ ঘিরে ধরে ঃ এতোদিন কেন বেঁচে আছো
মৃতরক্তে ভাসমান ঘোলাটে ফেনার জেগে থাকা –
জীবন জীবন বলে নেমে যায় মাটির ভিতরে
হিমবাহ ।
সবদিকে মুন্ডুহীন শরীরে শরীরে কালোভার –
একটি সামান্য রেখা, ক্ষত,উল্কি অগ্নির নির্মাণ তোমাকে ছাড়াই
আজ ওড়াতে চেয়েছি বহুদূরে –
যখন সমুলে তুলি দুই মুঠি তোমার চোয়ালে খরস্বান
একজন ফিসফিস করে ওঠে ঃ কাছে নদী, আয়তনহীন করে দেবে
সেই ছাই বহুদূরে থেকে নদী ফিরিয়ে দেবার কথা
বলে গেলো – তারও নীচে ন্যুব্জহাত
পাতাল শাসনে শান্তশীল –
এরও আগে প্রস্তর যুগের শুরু
হায় বর্ণমালা তুমি কতোকাল ছাই হয়ে আছো -
কালো হাত
এই হাত থেকে যদি যেতে হয়
রোমশ প্রশ্রয় থেকে বেঁকে –কি কেন কেমন টানে
কঠিন ভুরুর লেখা হিজিবিজি
আমারই মতন মনে হবে
কর্কশতর্জনী , ঘাম, মৃতসমুদ্রের নোংরা ফেনার
উদ্ধৃতি
যেন ঘিরে আছে সব দিকে, শীতল চিৎকার-
অদৃশ্যঅক্ষর মালা ঘুমিয়ে রয়েছে ঐ তালুর ভিতরে
যেন অভিপ্রায় ; অনতিশরীর –
তুমি কতটুকু জানো হাতের আড়ালে আছি কিনা
মুচড়ে ভাঙার মতো নির্দয় পিপাসা, অগ্নিউপদল
ভয়ালসংহতি নিয়ে আছি
জেগে উঠে দেখি রোজ লুকোনো ময়লার মতো
নিশাদল গুঁড়ো গুঁড়ো উড়ে যাচ্ছে দূরে –
উঠে আসে –
যতদূর দেখা যায় নিশ্চিত উদ্ধৃতিগুলি
ঘিরে ধরে ; টানে –
অনন্ত আঙুলে
আমি কেঁপে উঠিমূর্ছহীন ; কাছে যেতে অসংখ্য শিরায় দেখি
ফাঁস লেগে আছে ; কোনদিকে ভাঙা হবে
ভারী পিতলের পানপাত্রগুলি নীচে পড়ে
বেঁকে চুরে যায় –
আর উঠে আসে- কালো হাত
নিয়তবিশাল ; জেগে থাকে -
অজগর
কিছু বড়ো টলোমলো পা
এবার উঠতে চায় এঁকেবেঁকে শরতের দিকে-কুয়াশাতলায় শুধু অনুনয়:
'যাস্ নে রে খোকা'
ও দিকে মাঠের ধুধু কুচকাওয়াজের তালবীথি
হঠাৎ মধ্যরাত-ধুলোদের স্তবে লাগে হাওয়া
বন্ধ করো বন্ধ করো দরোজা জানালা আর
হৈ-হল্লা-বিশাল বন্দুক মাঠের গভীর থেকে
শিশিরের শব্দ শুনে টুকরো টুকরো
হতে থাকে
এবার সংক্ষিপ্ত হলো চাঁপাডাঙ্গা, আলপথ
ধমনীবিস্ফার জল-নলকূপ
এলোমেলো মাতাল ফিসফিস
কাঁপা হাত সাদা বর্ণ ছুটে যাচ্ছে ভোরের ইস্কুল
ছেলে বড়ো হলো তবে-শিকড় অন্ধের বেগে নামো
এবার বিপুল ছাই ঝরোঝরো
'যাস্ নে রে খোকা'
ছুঁয়ো না কখনও আমি উড়ে যাবো
ধরে থাকো ধুলোদের স্তব
উপহার
দিয়ে গ্যাছো বিষণ্ণ প্রলয়
মরিচা
দহন নামে দুটি ডিম পড়েছিলো
হে নদী,
তোমার নীল কিনারের কাছে
সরলবর্গীয়
ঘুমে গোলমুখ অবিকল আমাদেরই মুখের মতন
সে কথা
তোমার আজ মনে নেই
সেচে ও
শোষণে তুমি ক্ষীণ
কবে যে
ভেঙেছি মুখ রক্তের প্রথম কৌতূহলে
আজ মনে
নেই
খেলার
প্রদেশ থেকে ভাঙা ঘর
এলোমেলো
শ্রুতির মতন বালিয়াড়ি
শরীরের
ওমে ফেটে উড়ে গ্যাছে আরো দূর নদীর কিনারে
উড়ে
গ্যাছে জলফড়িং, সেই ডাঁটো জলের কিশোর
দুটি
পাখি ঠুকরে দিয়ে গ্যাছে ঘুম আমাদের যৌবনের কাজে
হে নদী,
তোমার চোখ
আজ কোন
পালক পল্লবও ধরে নেই
ঋণগ্রস্থ
পামরের চোখ –
প্রকৃত
শব্দের দুটি ঋণ এসে
ধূপের
আঠার মতো করে গ্যাছে দিন
অর্থের
অধিক দূরে নিরক্ষর দুটি পাখি –
তুমিও
কিশোর
জীবনযাপন
জুরে দিয়ে গ্যাছো বিষণ্ণপ্রলয় –
মুখোসের স্মৃতি রাখতে নেই
এখানে
উৎসব ফের
নেমে গেছে পরিধির জল
হাঁটুর নিবৃত্ত নীচে
রৌদ্রের শকুন ঘোরে ফেরে
এখন সকালবেলা- নির্বীজ চামড়ার মতো দুপুরের দিকে টান হবে
ফের
শুরু
করিডোরে মাপাশব্দ, এইচ এম-টির খুন
জলের প্রথায় সাদা ধেনো
আধডজন ভাড়াটে বৃশ্চিক প্রথমডাকের আগে
বদলে নেবে পিনকোড, বদলে নেবে
কাপডিশ, নালী ঘায়ে মৌ
আঙুলের বদলে
দস্তানা
হে
চোখ, বিষণ্ণ বোঁটা
কবে তুমি ডাঁসমাছি হলে
তোমার কি স্মৃতি নেই,
বিস্মৃতির জন্যে ক্ষোভ নেই
কুকুরের দাঁতে আয়না, পাসপোর্ট
অফিসে জাল সই
যাতে শুধু অপরেরই মুখ দেখা যায়
আমার মুখের চিত্রকল্প ঘুরে দলবদলের হাওয়া
আমার মুখের চিত্রকল্প জুড়ে
দলবদলের হাওয়া
আমি
তার প্রথম প্রমাণ
বাংলাদেশ
ভ্রান্তির
গহন থেকে ছুটে এসে এইমাত্র এখানে বসেছে
ঘাসফুল
না কি ঘুমন্ত ভ্রমর –
এতো
শান্ত ! চলাচলে জলতরঙ্গের মতো ছায়া –
মাঠের
এপার ঘেসে চলে যাচ্ছে টরেটক্কা, লুকোনো খবর-
আমি নীচু
হই; বলি , পালাও, পালাও ঐ বিস্তৃত ব্যবহারে-
অনন্ত
ঘোড়ার খুর আধাআধি ঝুলে আছে , যতদূর দেখা যায় গোল-
মাথার
ওপর ওড়ে সাদা গ্যালাক্সির লক্ষ ফেনা
আজ
রাত্রে কাদের শিবিরে ঠান্ডা চুরুটের ধোঁয়া ওড়ে, অস্ত্রে অবসাদ-
আমি
দ্রুত বুঝে নিচ্ছি মসলিনের জালপাতা, আগুন আড়াল করে
মানুষের
বাঁচা-
মূর্চ্ছার
মতন মাটি, জলামাঠ, গোপণ ম্যাপের গায়ে
সরু
পেনসিলের ওঠানামা-
তুমি
পলাতক, তুমি শস্যের গারদ থেকে
উড়ে এসে
বসেছ এখানে
কাদের
আঙুল আজ ছুটে আসে
বন্দীর
ভ্রমণে
ধানমাঠ;
ভাঙা সেতু ঘুমন্ত পল্লীর চোখে গড়ানো কাজল-
কোনো
বিপর্যয়, কোনো সীমান্তের আগুন বারুন নুন
একসঙ্গে
মিশে যাচ্ছে কিনা
টরেটক্কা
টরেটক্কা ; কাল ভোরে আত্মসমর্পণ -
যুগলপ্রসাদ
কে কাকে দহন করে, নষ্ট
অভিমান থেকে
ঝরে যায় ছাই
এখনো শুনতে পাও
কারা গাছ কাটে আর মিনতিলবণ
হয়ে
ছুঁয়ে থাকে অরণ্যের তীক্ষ্ণ হায় হায়
এই যে লাবণ্য আভা একেও
প্রতিমা করো
জীবনের মরণের
এরও নীচে একজন
আগুনের স্নেহে শুধু জ্বলে পুড়ে যায়
আবহমানের
প্রথমে
কোমল জল –বড়ো ছোট সব দিকে
গড়িয়ে
পড়েছে
পরে ধান
পোকা, ঝিঁ ঝিঁ মর্ত্যগাজনের মাঝে এসে
হতচকিতের মতো ভুলে
গেছে বংশ পরিচয়
ক্ষয়
নামে ক্ষয় –বিশাল বাঁধের থেকে
মাথায় মাথায় আসে- কলসী ও ছলাৎ শব্দে
জয় করে
নিতে চায় পায়ের আগুন তা তা মাটি
এই জয়
শেষ নয় – রাত্রি আসে প্রথমে উনুনে
রক্তকেশরের
লাল বীজ ফোটে – শোঁ শোঁ শব্দ
হাঁড়িতে
হাঁড়িতে
এই যে
গর্জন এই হয়ে আসা নদীমাতৃকার তলদেশ
পাথরের
মেরু থেকে অবিচ্ছিন্ন ইতর বিশেষ বারবার
ছুঁতে চায় ভাতের
সাদার মতো ভোর
প্রথমে
কোমলই হয় – পরে তপ্ত – শোঁ শোঁ ঝড়
শূন্যের স্তব্ধতা
ফেটে এক –দুই – তিন – চার
রাত্রি
আসে – হৈ-হৈ-হৌ –হৌ স্তিমিত ঘোরের নীচে
আহা-
ফুটন্ত
হাঁড়ির পাশে এই নদী
কে কার
অপেক্ষা রাখে আর -
শোকদিবস
একটি
সামান্য কথা বলে আজ রক্তপাত
কিছুতে
থামে না
ক্রমাগত
বারুদের ঢেউ ছিঁড়ে অবসাদ রশ্মির ভিতর
মুখ ও
আঙুলে হল্কা লাগে
আকাশের
নীচে খোলা প্রান্তিক করাতে জমে
জল-শরীরের
এই মানে শরীর ছুঁয়েই কেন নেমে যায়
দুপুরের
দিকে – ঘাসের ভিতরে তুমি কিছু কি মাখিয়ে রেখেছিলে
পা বেয়ে
উদ্ভিদ আজ কোথায় উঠেছে ঠিক বুঝতে পারি না
যেদিকে
তাকাই দেখি- কালো করাতের দাঁত
দিগন্তের
দিকে থেমে আছে
মাথার
উপরে চুলে নির্বোধ হাতের দুই মুঠো
সমূলে
ছিঁড়েছি নীরবতা
একে
রক্তপাত বলে কিন্তু নির্জনতা কার নাম
প্রেত
যাবার সময় খুব সহজেই বলে উঠি : যাই
সমস্ত অটুট থাকে ; হাতে-হাত, স্পর্শহীন, নিস্কর আগুন –
ভিজে কাগজের মতো উঠে যাই
দেখি
–
বিশাল নিলীমা ফুঁড়ে ওয়্যারলেসের লাল আলো
নিশ্চিহ্ন ভুরুর নীচে পুড়ে যাচ্ছে –ক্রূর –
পাশে জিটিরোড আর
লরির শিকল থেকে দুলে দুলে
ওঠে
ঝনাৎকার
;
পেট্রোলভ্যানের তীব্র কালো শীসে
দিগন্ত
করাতগুলি ভারী হয়ে ওঠে
টায়ারের মসৃণ সোঁ-সোঁ শব্দের ভিতরে আমাদের কোন কথা হল
পরস্ব শরীরে ছল, আঁকাবাঁকা রেখার প্রয়াস –
উঠে
দেখি-দূরে
সাপ ও শস্যের বিরোধিতাগুলি মুছে যাচ্ছে
সংকেতবিহীন
তোমার আমার কথা, বারুদে আস্তীর্ণ করতল
স্থির
হয়ে থাকে
অন্ধকারে ফেটে যাওয়া বীজের উল্লাসে ডুবে যায়
মুখের দুপাশে রোম অদৃশ্য চোয়াল
উঠে
দেখি-
তরল অক্ষরমালা ঝরে যাচ্ছে সোঁদাকাগজের প্রান্ত থেকে
হাতে-হাত, যন্ত্রনাবিহীন –
হেঁটে
যাই
মার্জিন
ওপাশে
উন্মাদ হলো হাওয়া রাগিণীর
এলোচুল
এপাশে
তখন সন্ধ্যা, কালো ভ্যান নেমেছে পাতালে
এখন শহর
স্থির
সাপের ফণায় অনুগত-
ফুটে ওঠো
শেফালিকা, ঝরে যেতে যদি ভালো লাগে
ঝরো –
নীচে পুলিশ তাড়ানো দুটি মানুষের
ছায়াও
পড়ে না দেখো-
তারা কি
ফুটেই ছিলো কোনদিন কোনো কোনো কালে
হাওয়া
রাগিনীর চুল, কাঁচের দেয়াল আর
টেবিল
ঘেঁসেই আছে
বৃত্তাকারে
সারি সারি পা
এখানে
অনেক উঁচু শেফালীর থেকে উঁচু
কানঢাকা
কার্নিশের গা
মাননীয়
মহাশয়, ক্ষিদেয় কখনও কারো
ফোস্কা পড়ে কিনা
তার রং তখন কেমন
এ সব এ
সব কথা ফেনায় ফেনায় ওঠে
হাওয়া রাগিনীর চুল
যখন উদ্দাম
নীচে
মানুষের ছায়া কেমন বিদেহী হয়
তারাও জানে না –
এখন
আমাকে তবে বলে দিন
অহং নামের পাশে দ্বীপ
হলে
সে নদী
কি খুব শান্ত হবে
জীবনলাল
আর্ত নয়, শুয়ে আছে, আকাশ দেখেছে তার
পৃষ্ঠদেশ – মেঘে ছায়াতপ
মাটি তাকে পাতাল-প্রবণ করে তোলে
আধিকিন্তু দৃশ্যটিও – দোমড়ানো বাঁশের বাতা
বিদ্যুৎ ক্যামেরা আর সেই রাতে জল ঝড়
রাস্তার ধারেই রয়ে গেছে –
যে সব গাছের বীজ কদমতলের মতো
একপা বাড়িয়ে দিয়ে স্থির
চেয়েছিলো
সেখানে ছুরিও নেই ধ্বস্তচিহ্ন-মানসাঙ্কে খুলে যায়
বিশাল কপাট, লাসঘর –
দিন যায়- দিন ; বিভ্রমের মধ্যে বাজে
মেঘের গুড়গুড় শব্দ – পালায় পালায় দূরে কালোভ্যান
পাতালের দিকে
আবার জীবনলাল নিঃশব্দে লাফিয়ে নামে
শহরের বনমহোৎসবে
অর্ধেক প্রশ্নের মতো সন্মোহন, কাদা মাটি
যে সব গাছের বীজ পদাঘাত বোঝাতে চেয়েছে
এবং জীবনলাল
লোকটা নিরীহ ছিলো, সেই রাত
আঙুলে জাগানো জল ঝড় -
মরণমৌসুমী
-১-
গৃহপরাভব
ছুঁয়ে ডানার কথিকাগুলি
কথা বলো-
ধূলোয় ভেজানো কন্ঠ বুক
কথা বলো
ফল্গুরেখা এ চোখে বালির অহমিকা
বাচালতা
খুঁজে নিক আমাদের পিপাসার দুল
-২-
ঘূর্ণিকে
ছাড়িয়ে দিলে কোন মূর্তি অবিচ্ছিন্নবাদী
মায়াদর্প
ফেরাবে কি কখনও সবুজে আধোলীন
তাহলে
তোমার হাত, কোন পায়ে মৃত নোখে
ধুলো
কুড়োবার ছল – ভয়াবহ জিমনাসিয়াম
-৩-
ভাষার
উন্মাদ বন্ধু আলো দেবে নিরন্নকুহকে
সত্য কি
কঠিন না কি লোল স্তবে গায়ন ভঙ্গিমা
পারো
দীপগাথা থেকে সরাতে সমস্ত কালো ধোঁয়া
মমতাময়াল
তুমি টের পাও, কবিত্বের সীমা
-৪-
কি ভাবে
সরিয়ে নেবো ইঁদুরের দাঁতে কাটা পটচিত্র ,
উদাসীনগর
– বাঁশঝাড়ে রক্তসূর্য সরে যায়
নিজের
ভিতরে – বিন্দু বিন্দু বল্লমের মুখ ছুঁয়ে
এই ঘুম –
তারা ফুল্কি –কুটোর অবোধ পরিত্রাণ
-৫-
তুমি কি
বোঝো নি সাদা – অর্থহীন মনে হয়েছিল
রৌদ্রে
কি চিনেছো মুখ প্রতিটা রেখার কুশলতা
ঠান্ডা
বারুদের নলে মায়াবী ধবল স্তব্ধ পাখী
আকাশ
বোঝে নি শুধু বাবুদের মনে রেখেছিল
-৬-
যে কনা
তুলেছে তার উপকথা শরীরে জড়ালে
আগুন
বর্ণনা করে সিঁড়িগুলি সমাজপুরাণ
বাঁ-হাত
পূজার মন্ত্র সপ্তডিঙ্গা শুধু অন্ধ ঘোরে
ছুঁতেও
পারো না তুমি – এ মানুষ লিপিদাস নয় -
-৭-
ও হাতে
ঘাতক সীমা , আজ জেগে ওঠে পররাগ
এ ভুল
আমারও ছিল, ছায়া কন্ঠে চেপে ধরি হাত
শস্য
ফুঁড়ে কে চেনালো বাঘনোখ – তোমার আমার
আকাশ
এখনো নীল কার বিষে বসুধা-বাসুকী
-৮-
যে ধারনা
আঁকা হলো তার ধ্বনি শিকড়ে প্রোথিত
জল দিয়ে
স্নেহ দিয়ে লালন করেছো অন্ধগান
বুঝি নি
এখনো আমি এত ভালোবাসা রেখেছিলে
পাথর
ছাপানো জলে ভেসে যায় অঞ্জলির হাত
-৯-
সে
হারিয়ে গেছে তার প্রচ্ছায়া ঘিরেছে প্রশ্নসীমা
পেছনে
কুকুর, রাত্রি দূরে লেলিহান লোকগাথা
মনে পড়ে
সেইসব কথাসাগরের সাদা ফেনা
মহিমাগলিত
দেহ পোকার মূখর আলোচনা
-১০-
দুটি
হাত, বধিরতা, নীল শিরা শুধু জেগে আছে
ও হাত
বোঝেনা কিছু অন্ধকার চায় ক্ষমাচ্ছলে
হলুদ
আভার তাপে দুটি শিশু তোমারই নিকষ
ক্ষত
বসুধার টান – তুমিও ওদের ধরে রেখো
*******************************