পরিচালক বাক্
Wednesday, July 6, 2016
কারুবাসনা যাকে নষ্ট করেছে সে-ই কবি। যার মাথায় প্রতিষ্ঠানের বিরাট বিরাট
নখওয়ালা হাত, যার সঙ্গে হাসিমুখে ছবি তুলছেন প্রতাপান্বিত কবি, যে রাষ্ট্রের ছাতার
বাঁট সজোরে ধরে আছে যাতে অকালবৃষ্টিতে ভিজে না যায়, যে বিদ্রোহী কবিতাকে দমন করতে
তৎপর, যে কোনো অন্যরকম লেখাকে যে বিদ্রূপ করে- সে কবি কেন হবে? সমাজে চতুরের ভেকের
অভাব নেই। কেউ সমাজসেবী সাজে, কেউ পলিটিশিয়ান, কেউ কবি।
আচ্ছা, বাণিজ্যিক কাগজে কবিতা লিখে যদি ৩০০ টাকা পাওয়া যায়, গল্প লিখলে
নাকি ২০০০ মেলে। কেন? কবিতার চেয়ে গল্পের দাম বেশি বলে, নাকি গল্প লিখতে অনেক শব্দ
লাগে বলে? যদি দীর্ঘকবিতা হয়?
‘তাজমহল দেখলাম। মোটামুটি লাগল। আরো ভালো
হতে পারত। পুরো সাদা না করে একটু কালো রঙ ব্যবহার করা যেত। সামনের বাগানটায় কিছু
পেয়ারা গাছ থাকলে পেড়ে খাওয়া যেত।’- আনন্দবাজারের সাহিত্য-শিল্প আর সিনেমার আলোচনা
ঠিক এভাবে হয়। আর আনন্দবাজার থেকেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি ঠিক করে নেয় কোন-কোন
‘বই’ দ্যাখার মতো, বা পড়ার মতো হয়েছে, কে আজ ‘ভালো’ লেখক, কে ‘দারুণ’ পরিচালক।
জীবনানন্দ দাশের কবিতার কোনো মূল্য আজ আর
নেই। তাঁকে পড়ে আজও কবিতা পড়ার অসীম আনন্দ পাওয়া যায়, এটুকুই। কবিদের কবি তিনি আজ আর নন। প্রতিষ্ঠান তবু তাঁর কবিতা আর মিথ-কে
জাগিয়ে রাখতে চায়, কারন আজকের
প্রাতিষ্ঠানিক বস্তাপচা কবিতার ভিত তিনি সরে গেলে কিছুই বাকি থাকে না। যখন তিনি
সত্যিই প্রয়োজনীয় কাজগুলো করছিলেন, বাংলা কবিতার বাঁক
ফেরাচ্ছিলেন, জীবনানন্দকে অবহেলা ছাড়া কিছু দেওয়া হয়নি। চরম
অবজ্ঞা আর অবিচারের মধ্যে লোকটিকে মরতে হয়েছিল। আজ তাঁর মিথ্যে পুজোর মধ্যে সেই
অনুতাপ লক্ষ্য করা যায় না। আজ বরং তাঁর উপন্যাসগুলো অনেক প্রাসঙ্গিক। জীবনানন্দ
আজও উপন্যাস লেখক হিসেবে এখনকার যে কোনো জীবিত ঔপন্যাসিকের চেয়ে মহৎ এবং জ্যান্ত।
কিন্তু তাঁর উপন্যাস এখানে পড়াই হয় না। পাওয়াই যায় না। অনেকেই শুধু 'বনলতা সেন' পড়ে। 'কারুবাসনা'
বা 'জলপাইহাটি'-র দিকে
ফিরেও তাকায় না।
কোনো বিপ্লবীই ব্যর্থ হননি। কারন কোনো
বিপ্লবই আজ অবধি বিফল হয়নি। বিপ্লবকে হাতের মুঠোয় নিয়ে যখন দেখতে পাচ্ছেন, সে তখনও
কাঁচা। বিপ্লবের পরিণতি যখন সে একটা বিদীর্ণ ফলের মতো মাটিতে পড়ে থাকে। আর তার
বীজগুলো চতুর্দিকে ছড়িয়ে যায়। যে গাছগুলো পরে হবে, তারা ওই বিপ্লবের জেনেটিক
উত্তরাধিকার বহন করে। তারা সচেতন কিনা, পরের কথা।
এ দেশের মানুষ বিশ্বাস করে- ‘অতি বাড় বেড়ো
না, ঝড়ে পড়ে যাবে’। এ-দেশের মানুষ সন্তানকে শিক্ষা দ্যায়- ‘আগে গেলে বাঘে খায়/
পিছে গেলে সোনা পায়’। এ-দেশে দোকানের সামনে
লেবুলংকা ঝোলানো আজ কম্পালসারি হয়ে উঠছে। এ-দেশে বিরাট বাড়ি করলে তার সামনে জুতো
ঝুলিয়ে রাখতে হয়।
এ-দেশে কবিতা লিখে আপনি কী করবেন, ‘দেশ’-এ
কোবিতা ছাপানো ছাড়া আর কোন কৃতিত্ব আপনি আশা করতে পারেন?
অনুপম মুখোপাধ্যায়
পরিচালক বাক্
পরিচালক বাক্